ঢাকা ,
বার : সোমবার
তারিখ : ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
বাংলা : ৮ পৌষ ১৪৩১
Dcnewsbd Facebook
Dcnewsbd Twitter

শিরোনাম :

প্রথম পাতা সম্পাদকীয় উপ-সম্পাদকীয় বড়দিনের আধ্যাত্মিকতা

বড়দিনের আধ্যাত্মিকতা

0
764

|| ফাদার জয়ন্ত এস. গমেজ ||
বড়দিন কী! কেন! এর মর্মসত্য! বড়দিন আমাদের কাছে কি দাবি করেÑ এই নিয়েই বড়দিনের আধ্যাত্মিকতা। সহজ কথায়, বড়দিন ঈশ্বর তনয় যিশু খ্রিস্টের জন্মদিন। বড়দিন খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় উৎসব। কি বিশ্বাসে, কি ভক্তিতে, কি উৎসবে, বিশ্বময় বড়দিন একটি সর্বজনীন উৎসব। এদিনেÑঈশ্বরের সঙ্গে মানুষের, মানুষে-মানুষে এমনকি সমস্ত সৃষ্টির মধ্যে স্থাপিত হয় এক মিলন-বন্ধন। নিরাকার ঈশ্বর হলেন সাকার। অসীম সৃষ্টিকর্তা ধরা দিলেন সমীম মানুষের পৃথিবীতে। স্বর্গের সঙ্গে মর্তের তৈরি হল চিরমুক্তির সেতুবন্ধন। ঈশ্বর মানুষ হলেন, যেন মানুষ ঈশ্বরের মতো হতে পারে। তিনি নমিত হলেন, যাতে মানুষ উন্নীত হতে পারে। তিনি এলেন অন্ধকারাচ্ছন্ন পৃথিবীতে আলো হয়ে। মানুষকে অন্ধকার থেকে আলোতে, অসত্য থেকে সত্যে এবং মৃত্যু থেকে অমৃতধামে নিয়ে যেতে। এজন্য তিনি সর্বোচ্চ ত্যাগ, আত্মোৎসর্গ অর্থাৎ ক্রুশো’পরে জীবন উৎসর্গ করলেন। তিনি আমাদের ভালবাসলেন। আমাদের জন্য জীবন দিলেন, যাতে আমরা অনন্ত জীবনের অধিকারী হতে পারি। যাতে স্বর্গীয় আলোর মানুষ হতে পারি।

বাইবেলের পুরাতন নিয়মে প্রবক্তা ইসাইয়া বহু বছর পূর্বে যিশুর জন্ম সম্পর্কে বলেছেন: “ সেদিন জেসে-বংশের সেই মূল কাণ্ড থেকে বেরিয়ে আসবে একটি নতুন পল্লব, জেসে-বংশের সেই শিকড় থেকে জন্ম নেবে একটি নতুন অঙ্কুর। সেই নতুন অঙ্কুর যিনি, তাঁর ওপর অধিষ্ঠিত থাকবে ভগবানের আত্মিক প্রেরণাÑ প্রজ্ঞা ও বোধবুদ্ধিরই আত্মিক প্রেরণা, সৎ উদ্দেশ্য ও সৎসাহসেরই আত্মিক প্রেরণা, সদ্জ্ঞান ও ভগবৎ-সম্ভ্রমেরই আত্মিক প্রেরণা। আর এই ভগবৎ-সম্ভ্রম তাঁকে অনুপ্রাণিত করবে। তিনি বাইরের চেহারা দেখে কারও বিচার করবেন না, পরের কথায় কান দিয়ে রায়-ও দেবেন না; বরং তিনি দুর্বল-অসহায় মানুষের বিচার করবেন ধর্মেরই নীতিতে, এ পৃথিবীর যত দীনজনের সপক্ষে রায় দেবেন ন্যায়েরই বিধানে। — ধর্মিষ্ঠতা হবে তাঁর কটিবাস, বিশ্বস্ততা হবে তাঁর কোমর-বন্ধনী। তখন নেকড়ে বাঘ মেষশাবকের সঙ্গে বাস করবে, চিতাবাঘ শুয়ে থাবে ছাগলছানার পাশে। বাছুর আর সিংহের বাচ্চা একসঙ্গেই চরে বেড়াবে;–দুধের শিশু তখন কেউটে সাপের গর্তের ওপর খেলা করবে;” (ইসাইয়া ১১:১-৮)। তিনি আরও বলেছেন, “এবার খুলে যাবে অন্ধের চোখ, অবারিত হবে বধিরের কান। এবার খোঁড়া মানুষ লাফিয়ে উঠবে হরিণেরই মতো; বোবার জিভে জেগে উঠবে আনন্দের ধ্বণি। –মরু প্রান্তরের বুকে বয়ে চলবে খরস্রোতা যত নদী।” (ইসাইয়া ৩৫:৫-৭)।
মুক্তির সূর্য, জগদজ্যোতি, যিনি আসছেন- তিনি মানবজাতির দুঃখ-দর্দশা, অশান্তি, বিবাদ, বিশৃংখলা এবং সকল পাপময়তা দূর করে দেবেন। পাপের বন্দিদশা এবং মন্দতার নাগপাশ থেকে মানুষকে আলোর পথের সন্ধান দিতে তিনি আসছেন। তাঁর আগমনে ঘুচে যাবে সব অন্ধকার, দুঃখ-দর্দশা। বাইবেলের নতুন নিয়মে তাঁর আগমন সম্পর্কে বলা হয়েছে: “স্বর্গদূত তখন তাঁকে বললেন, ভয় পেয়ো না, মারীয়া! তুমি পরমেশ্বরের অনুগ্রহ লাভ করেছ। শোন, গর্ভধারণ ক’রে তুমি একটি পুত্রের জন্ম দেবে। তাঁর নাম রাখবে যীশু। তিনি মহান হয়ে উঠবেন, পরাৎপরের পুত্র বলে পরিচিত হবেন। প্রভু পরমেশ্বর তাঁকে দান করবেন তাঁর পিতৃপুরুষ দাউদের সিংহাসন। যাকোব-বংশের ওপর তিনি চিরকাল রাজত্ব করবেন; অশেষ হবে তাঁর রাজত্ব।” (লুক ১:৩১-৩৩)।
মঙ্গলসমাচার রচয়িতা যোহন লিখেছেন, “আদিতে ছিলেন বাণী; বাণী ছিলেন ঈশ্বরের সঙ্গে, বাণী ছিলেন ঈশ্বর। — রক্তগত জন্মে নয়Ñ দেহের বাসনা থেকে নয়, পুরুষের কামনা থেকেও নয়Ñ তাদেরই এই জন্ম ঈশ্বর থেকেই। –তাঁর মধ্যে ছিল জীবন; সেই জীবন ছিল মানুষের আলো; বাণী একদিন হলেন রক্তমাংসের মানুষ; বাস করতে লাগলেন আমাদেরই মাঝখানে”। (যোহন ১:১-৪,১৩,১৪)। প্রবক্তা যোহন যিশু সম্পর্কে বলেছেন, “আমার পরে আসছেন এমন একজন, যিনি আমার চেয়ে শক্তিশালী। আমি যে নিচু হয়ে তাঁর জুতোর বাঁধন খুলে দেব, সে যোগ্যতাও আমার নেই। আমি তো জল দিয়েই তোমাদের দীক্ষাস্নাত করেছি; তিনি কিন্তু পবিত্র আত্মায় অবগাহন করিয়েই তোমাদের দীক্ষাস্নাত করবেন”। (মার্ক ১:৭-৮)।

বড়দিন, একদিকে যেমন ভালবাসার উৎসব, অন্যদিকে ঈশ্বরের প্রতি মানবজাতির কৃতজ্ঞতা জানানোর দিন। কেননা, মানবজাতির মুক্তির জন্য ঈশ্বর তনয় যিশু মানুষ হয়ে মানুষের ঘরে জন্ম নিলেন। যিশুর মানব দেহগ্রহণের মধ্য দিয়ে ঈশ্বর মানব জাতির সঙ্গে একাত্ম হলেন। ভালবাসার বন্ধনে আবদ্ধ হলেন। সকল মানবজাতির পক্ষে কুমারী মারীয়া যিশুকে গর্ভে ধারণ করার মধ্য দিয়ে ঈশ্বরের মঙ্গলময় ইচ্ছায় আত্মসমর্পণ করলেন। তিনি হয়ে উঠলেন নবীনা হবা। আদম-হবার অবাধ্যতার মধ্য দিয়ে পৃথিবীতে যে পাপের সূচনা ঘটেছিল, দ্বিতীয় হবা কুমারী মারীয়ার বাধ্যতার দ্বারা তা স্খলন হল। অনন্তকালীন ঐশকৃপার দ্বার হল উন্মোচিত। মুক্তির ইতিহাস পেল পূর্ণতা ক্রুশো’পরে যিশুর জীবন উৎসর্গে মানুষের মুক্তি সুনিশ্চিত হল।

বড়দিন হল মিলনের দিন। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে, ধনী-গরীব, প্রভু-ভৃত্য, প্রতিবন্ধী এবং সকল প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সঙ্গে পারস্পরিক ভালবাসা, মিলন ও ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠার দিন। সকল বিবাদ-বিশৃংখলা, মান-অভিমান, হিংসা-বিদ্বেষ, ভেদাভেদ, বিচ্ছিন্নতা, স্বার্থপরতা ভুলে গিয়ে বিমল আনন্দ ও আন্তরিক ভালবাসায় পরস্পরকে গ্রহণের দিন। ঈশ্বরের-মানুষে এবং মানুষে-মানুষে প্রীতির বন্ধন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে যে সকল বাধা ও চ্যালেঞ্জ রয়েছে, তা পরিত্যাগ করা। জীবনের যত আঁকা-বাঁকা রাস্তা, অসমতল ভূমি, গিরিখাতগুলোকে সংস্কার ক’রে সোজা-সরল ও সমতল করা। আচার-আচরণ, মন-মানসিকতায় খ্রিষ্টীয় আদর্শ ও মূল্যবোধের প্রকাশ ঘটিয়ে পারস্পরিক মিলন, ভ্রাতৃত্ব ও শান্তি প্রতিষ্ঠা করা।
বিশ্বময় করোনার আঘাতে বিপর্যস্ত অবস্থা আমাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেয় ঈশ্বরকে বাদ দিয়ে আমাদের জীবনের অস্তিত্ব বিপন্ন। জীবনের সর্বক্ষেত্রে ঈশ্বরের প্রয়োজনীয়তা এবং তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখা আমাদের জন্য জরুরি। সেজন্যে ঈশ্বর আমাদের সঙ্গে বাস করতে মর্তধামে এলেন। তিনি ইম্মানুয়েল। সবকিছুর মধ্যে ঈশ্বরের ভালবাসা, দয়া এবং তাঁর সক্রিয় উপস্থিতি অনুভব করা, আবিষ্কার করা, আমাদের জীবনকে পাল্টে দিতে পারে। প্রকৃতির সঙ্গে আমাদের জীবন আষ্টেপিষ্ঠে জড়িয়ে রয়েছে। প্রকৃতিকে ভালবাসা, তার যত্ন নেওয়া আমাদের পবিত্র দায়িত্ব।
বড়দিন, আমাদের সকলকে বড় মনের মানুষ হতে, আরেকটু ভাল খ্রিষ্টান হতে প্রেরণা দিক। শুভ বড়দিন।