ঢাকা ,
বার : সোমবার
তারিখ : ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
বাংলা : ৯ পৌষ ১৪৩১
Dcnewsbd Facebook
Dcnewsbd Twitter

শিরোনাম :

প্রথম পাতা ফিচার পুণ্যভূমি পানজোরা: সাধু আন্তনীর প্রতি বিশ্বাসের যাত্রা

পুণ্যভূমি পানজোরা: সাধু আন্তনীর প্রতি বিশ্বাসের যাত্রা

0
1334

৩ ফেব্রুয়ারি, শুক্রবার, গাজীপুরের কালিগঞ্জের নাগরীর পানজোরা গ্রাম। পুবের আকাশে প্রতিদিনের মতোই সূর্য উঠেছে। তবে আজকের সূর্য নতুন এক বার্তা নিয়ে এসেছে। আগের দিন তো বটেই ভোর রাত থেকেই নাগরীর পানজোরা ও আশপাশের গ্রামের মানুষের মধ্যে এক ধরনের কর্মব্যস্ততা শুরু  হয়ে গেছে। প্রতিবছর এই সময়ে নাগরীবাসীর মধ্যে বিশেষ এক কর্মব্যস্ততা চোখে পড়ে। দিনকে ঘিরে চলতে থাকে নানা প্রস্তুতিও।

৯ দিন আধ্যাত্মিক প্রস্তুতি বা নভেনার পর আসে সেই শুভক্ষণ, সেই আনন্দময় মুহুর্ত। আর সেই ক্ষণটি মহান সাধু আন্তনীকে সাদরে বরণ করে নেওয়ার, পূঁজা-অর্চনা করার, তাঁকে হৃদয়ে গ্রহণ করার। শুধু নাগরীবাসী নয়, বিশ্বের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা আন্তনী ভক্তরা ছুটে আসেন বাংলাদেশের গাজীপুর জেলার এই পানজোরাতে।

03সাধু আন্তনীর পর্বের দিন ঘনিয়ে এলেই পানজোরা ও এর আশপাশের পাড়ায় উৎসবের ধুম পড়ে। তাই পানজোরার জনগণ সারা বছর অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় থাকেন কখন আসবে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ, সাধু আন্তনীর মহাতীর্থোৎসব।
সাধু আন্তনীর পর্বকে উপলক্ষ্য করে পানজোরাসহ পুরো এলাকায় কয়েক স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করতে দেখা গেছে। নিজেদের নিরাপত্তা ও স্বেচ্ছাসেবী ছাড়াও প্রশাসনের কড়া নিরাপত্তা চোখে পড়েছে ।

ইতিমধ্যে নাগরীর পানজোরা সাধু আন্তনীর তীর্থস্থান হিসেবে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেছে। দেশ ও দেশের বাইরে এ তীর্থস্থানের নাম ছড়িয়ে গেছে।প্রতি বছর সাধু আন্তনীকে ভালবেসে এই সময়ে  প্রবাসী বাংলাদেশিরা ছুটে আসেন তাঁদের প্রিয় এই তীর্থভূমিতে। পাশাপাশি দেশের নানা প্রান্তের সাধু আন্তনী ভক্তরাও ছুটে আসেন নাগরীতে, তাঁর প্রতি ভক্তি, শ্রদ্ধা ও প্রণাম জানাতে। তাদের মনোবাঞ্জা (মানত) সাধু আন্তনীর মাধ্যমে ঈশ্বরের কাছে তুলে ধরতে।

এদিন শীত ও কুঁয়াশা উপেক্ষা করে সাধু আন্তনীর ভক্তরা দলেদলে পানজোরাতে আসতে থাকে। দূরদুরান্ত থেকে বাস, মাইক্রোবাস, প্রাইভেটকার, সিএনজি, অটোরিক্সা এবং পায়ে হেঁটে তাদের আসতে দেখা যায়। যতদূর চোখ যায় ভক্তদের দীর্ঘ সারি চোখে পড়ে। কয়েক কিলোমিটার রাস্তা জুড়ে শুধু মানুষের জনস্রোত ও গাড়ির দীর্ঘ সারি। ছিল কার পার্কিং-এর জন্য বিশেষ ব্যবস্থাও। মানুষের চলাচল নির্বিঘ্ন করতে তীর্থস্থানে পৌঁছার কয়েক কিলোমিটার আগেই যানচলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়। পর্বকে ঘিরে রাস্তায় খোলা আকাশের নীচে দোকানিরা নানা পণ্যের পসরা সাজিয়ে  বসেছিলেন। কেনাবেচাও বেশ ভাল হয়েছে। স্থানীয় কৃষিপণ্যের পাশাপাশি ফলমূল, বিভিন্ন ধর্মীয় মূর্তি ও বই এবং খাবারে দোকান চোখে পড়ে।

স্কুল শিক্ষার্থী সিলভিয়া ডি’ কস্তা এসেছিলেন ঢাকার নদ্দা থেকে। তিনি বলেন, ‘আমি পঞ্চমবারের মতো এখানে এসেছি। খুব ভাল লাগে, অন্তরে প্রশান্তি অনুভব করি। তবে অন্যান্যবারের থেকে এবারের পর্বটি বিশেষ স্পেশাল আমার কাছে। কারণ সাধু আন্তনীর দেহাবশেষের একটা অংশ এখানে রয়েছে। এখানে এসে বিশেষ প্রার্থনা করেছি। দিদিমাসহ বাসার সবাই যাতে সুস্থ থাকে, ভাল থাকে। যাতে পড়াশোনায় ভাল করতে পারি, অনেক বড় হতে পারি।’

04কাজিপাড়া মিরপুর থেকে এসেছিলেন শেফালি গমেজ। তিনি জানালেন, ‘আমি আগে দু-বার এসেছি। এবার স্বপরিবারে এসেছি। অসুস্থ ছিলাম, সুস্থ হয়ে তাঁর চরণে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানাতে এসেছি। খুব খুশি লাগছে। এমন দিন পাবো ভাবিনি। আশা করি সামনে এমন খুশির দিন আরো পাবো এবং আপনাদের সাথে যেন আবারো দেখা হবে।সাধু আন্তনীর দেহবাশেষ এখানে এসেছে, এর জন্য আরো খুশি ও ভাল লাগছে। তাঁর আশির্বাদ নিতে এসেছি। যতদিন আছি যেন সুস্থ-সুন্দর থাকি এবং সর্বদা তাঁর সেবায় নিয়োজিত থাকি।’

নেত্রকোণা জেলার বিরিশিরির কলেজ শিক্ষার্থী সোনিয়া মান্দা তীর্থ উৎসবে যোগদান শেষে বলছিলেন, ‘প্রতিবছরই আসা হয়। এবছরও এসেছি। ভাল লাগছে।বিশ্বাস আছে বলেই আসি। তাঁর কাছে যা চাই তা-ই পাই। হারানো জিনিস ফিরে পাই। আমার ফরম ফিলাপ-এর কাগজ খুঁজে পাচ্ছিলাম না, তাঁকে স্মরণ করলাম, দুইদিন পর পেয়ে যায়।আমি যেন আরো পড়াশোনা করতে পারি, বড় হতে পারি সেই আশির্বাদ চেয়েছি এবং যাতে বাকিটা  জীবন তাঁকে বিশ্বাস করে যেতে পারি। পরিবারে শান্তি ও বন্ধুত্ব যেন সর্বদা বজায় থাকে।’

নারায়নগঞ্জের সাধু আন্তনীর একজন নারী ভক্ত বলছিলেন, ছোটবেলা থেকেই এই তীর্থে আসি, আমার ভাল লাগে। আগে মা-বাবার সাথে আসতাম এখন স্বামী-সন্তান নিয়ে আসি। এটাতো এক ধরনের মিলনমেলা এবং আধ্যাত্মিক বিষয়টিও রয়েছে। অনেকের সাথে দেখা হয়। সবাই অনেক বিশ্বাস নিয়ে আসে। এসে অনেকেই স্বাক্ষ্য দেয়, প্রার্থনা করে। অনেকে সাকসেস হয়েছে। এটি যার যার বিশ্বাস।

02একজন হিন্দু মহিলা যার সন্তান হতো না, সেও এখানে এসে স্বাক্ষ্য দিয়ে গেছে। তিনি বলেছেন, ‘আগে খালি হাতে আসতাম, এবার আমার সন্তানসহ এসেছি। সবাই একটা আকাঙ্খা নিয়ে আসছে। ভাতিকান থেকে সাধু আন্তনীর দেহাবশেষ নিয়ে আসা হয়েছে। আমরা অবশ্যই সেটি দেখে যাব। ধর্ম যার যার উৎসব সবার। সবাই সবার প্রতি যেন বিশ্বস্ত থাকি এবং একে অন্যকে ভালবাসতে পারি। দেশ ও বিশ্বশান্তির জন্য বিশেষ প্রার্থনা করি। দেশে জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদ যেন না থাকে এবং যারা এই পথে পা বাড়িয়েছে তারা যেন ধ্বংসের পথ পরিহার করে মন পরিবর্তন করতে পারে। তাদের জন্যেও প্রার্থনা করবো।’

স্থানীয় গৃহিণী শাহনাজ বলছিলেন, ‘ছোটবেলাতন দেইখ্যা আইতাছি। তাগর কষ্ট দেইখ্যা প্রশ্ন করি এতদুরতন হেরাই আয়ে। তাগর ইমান দেইখ্যা অবাক অই। দুরেতন কত কষ্ট কইরা তারা আহে। তারা বিশ্বাস নিয়েই আহে। ইমান আসে বইলাই  আহে।’

সাধু আন্তনীর এই তীর্থ উৎসবে মহাখ্রিষ্টযাগ পরিচালনা করেন কার্ডিনাল প্যাট্রিক ডি’রোজারিও সিএসসি। তিনি তাঁর খ্রিষ্টযাগের বক্তব্যে বলেন, ‘সাধু আন্তনীকে আমরা ভালবাসি। আমাদের অনেক ভক্তি ও শ্রদ্ধা তাঁর প্রতি। তিনি অলৌকিকভাবে আমাদের মাঝে উপস্থিত হয়েছেন। সাধু আন্তনী বলছেন, জানি তোমাদের প্রার্থনা। তাইতো তোমাদের কাছে এসেছি। যাতে তোমাদেরকে যিশুর ভালবাসা দিতে পারি এবং যিশুর কাছে নিয়ে যেতে পারি।’

এবারে নাগরীর পানজোরাতে সাধু আন্তনীর পর্ব উদযাপন বিশেষ এক মাত্রা দিয়েছে।কারণ এ বছর ইতালির ভাতিকান থেকে সাধু আন্তনীর দেহাবশেষ নিয়ে আসা হয়েছে। যাতে তাঁর বিশেষ অনুগ্রহ বাংলাদেশের জনগন ও খ্রিষ্টবিশ্বাসীরা লাভ করতে পারেন।

এজন্য পানজোরাতে এবারের তীর্থ উৎসবে তিলধারণেরও জায়গা ছিল না। দুটো খ্রিষ্টযাগেই পুরো তীর্থস্থান কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায়। ভেতরে জায়গা না হওয়ায় অনেককে বাইরে থেকে খ্রিষ্টযাগে যোগ দিতে দেখা যায়। পেছনের সারিতে কেউ দাঁড়িয়ে কেউ-বা বসে এই মহাখ্রিষ্টযাগে যোগ দেন। প্রতি বছর ফেব্রুয়ারি প্রথম শুক্রবার পানজোরাতে সাধু আন্তনীর পার্বণ অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। ভক্তি, ভালবাসায় আর বিশ্বাসে প্রতি বছর পানজোরার সাধু আন্তনীর তীর্থস্থান হয়ে উঠুক মহাপুণ্যভূমি ॥

আরবি/আরপি/এসএস/ ৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭