শিরোনাম :
পরলোকে দিনাজপুরের ২২টি সমবায় সমিতির প্রতিষ্ঠাতা ফাদার জুলিও বেরূর্ত্তি পিমে
ডিসিনিউজ ॥ ঢাকা
দিনাজপুর ক্যাথলিক ধর্মপ্রদেশে বাইশটি সমবায় সমিতির প্রতিষ্ঠাতা ইটালিয়ান পিমে মিশনারি ফাদার জুলিও বেরূর্ত্তি আর নেই। তিনি ১১ আগস্ট রাত এগারটার দিকে অসুস্থাবস্থায় রাজধানীর একটি হাসপাতালে মারা গেছেন বলে জানিয়েছেন দিনাজপুরের বিশপ সেবাষ্টিয়ান টুডু। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৭ বছর।
১৯৪৩ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ অক্টোবর ইটালির ভারেসে প্রভিন্সির বুস্টো আরসিজিও শহরে জন্ম নেওয়া ফাদার জুলিও বেরূর্ত্তি পুরোহিত হন ১৯৭০ সনের ২৭ জুন। পুরোহিত হওয়ার কয়েক বছর পরই তিনি বাংলাদেশে আসেন। পাল-পুরোহিত হিসেবে সেবা দিয়েছেন ধর্মপ্রদেশের মারিয়ামপুর, নিজপাড়া ও পাথরঘাটা ধর্মপল্লীতে।
মারিয়ামপুর ধর্মপল্লীর পাল-পুরোহিত স্যামশন মারান্ডি ডিসিনিউজকে বলেন, ফাদার বেরূর্ত্তি প্রথম পাথরঘাটা ধর্মপল্লীতে ‘পাথরঘাটা মিশন কো-অপারেটিভ ক্রেডিট ইউনিয়ন’ গঠন করেন। পর্যায় ক্রমে দিনাজপুরের প্রতিটি ধর্মপল্লীতে সমবায় সমিতি গঠন করে সমবায় আন্দোলন ছড়িয়ে দিয়েছেন প্রত্যান্ত অঞ্চলে। তাঁর সমবায় আন্দোলনের মাধ্যমে উপকৃত হয়েছেন ধর্মপ্রদেশের হাজার হাজার মানুষ।’
তিনি দীর্ঘ সময় দিনাজপুর ক্যাথলিক ধর্মপ্রদেশের ক্রেডিট ইউনিয়ন ক্রার্যক্রমের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এই ধর্মপ্রদেশের ২২টি ধর্মপল্লীতে ২২টি ক্রেডিট ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠা করে তিনি ধর্মপ্রদেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে অবদান রেখেছেন।
এই সমবায় সমিতিগুলোর একটি হলো মারিয়ামপুর ক্রেডিট ইউনিয়ন, যার সঞ্চয় ও শেয়ার সদস্য দশ হাজারের অধিক।
দিনাজপুর ক্যাথলিক ধর্মপ্রদেশের ক্রেডিট ইউনিয়ন ক্রার্যক্রমের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক পাউলুস হাসদা ডিসিনিউজকে বলেন, ‘ফাদার বেরূর্ত্তি যখন পাথরঘাটা ধর্মপল্লীতে প্রথম সমবায় কার্যক্রম শুরু করেন, তখন তিনি নিজে গ্রামে গ্রামে পাঁয়ে হেটে সঞ্চয় জমা নিতেন, নিজেে বই লিখতেন। সঞ্চয়ী হওয়ার জন্য খ্রিষ্টভক্তদের উৎসাহিত করতেন। সদস্যদের সমবায়ের গুরুত্ব শিক্ষা দিতেন।’
ফাদার বেরূর্ত্তি সমবায়ের বিভিন্ন কর্মশালায় অংশ নিয়ে ও বই পড়ে সমবায় আন্দোলন সম্পর্কে শিখেন। দীর্ঘ ২২ বছর ফাদার বেরূর্ত্তির সাথে কাজ করা পাউলুস হাসদা বলেন, ‘আমি দেখেছি সমবায়ীদের জন্য শিক্ষা সেমিনার আয়োজন করে তিনি নিজেও দর্শকদের সাথে বসে যেতেন। সমবায় সম্পর্কে শিক্ষা লাভ করে তা বাস্তবে কাজে লাগাতেন।’
ফাদার বেরূর্ত্তি অনুৎপাদনশীল খাতে তিনি সমবায় সমিতি থেকে কোনো ঋণ দিতেন না। পাউলুস হাসদা বলেন, ‘ফাদার বেরূর্ত্তি বিবাহ বা অন্য কোনো সামাজিক অনুষ্ঠানে খরচ করার জন্য কোনো ঋণ সমবায় সমিতি থেকে দেন না। এই চর্চা দিনাজপুরের সমবায় সমিতিগুলো এখনো করে। আমরা বলি অনুষ্ঠানে খরচ করার জন্য আগে থেকে সঞ্চয় করার জন্য।’
তিনি জানান, দিনাজপুরে বেশির ভাগ আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বাস। সেখানকার সমবায় সমিতির সদস্যরা মূলত ঋণ নিয়ে থাকে কৃষি কাজের জন্য, অনেকে গৃহ নির্মাণ বা মেরামত, ব্যবসায় বিনিয়োগ, গরু, ছাগল ক্রয় করার জন্য।
পাউলুস হাসদা বলেন, ‘ফাদার বেরূর্ত্তি ছিলেন একজন নীতিবান পিমে মিশনারি। তিনি ন্যায্যতার পক্ষে কথা বলতে ভয় পেতেন না। তাই সবাই তাঁকে সমীহ করতো। তাঁর কথা শুনতো। তিনি অনেক জায়গায় বিচার-শালিসে গিয়ে ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা করেছেন।’
আধ্যাত্মিক, আর্থসামাজিক উন্নয়ন কাজের পাশাপাশি তিনি প্রশাসনিক কাজেও দক্ষ ছিলেন। বিভিন্ন সময় পরিচালক হিসেবে সেবা করেছেন দিনাজপুরের সেন্ট ভিনসেন্ট হাসপাতাল, ধানঝুড়ি কুষ্ঠ হাসপাতাল ও নভারা করিগরি বিদ্যালয়ে। এ ছাড়া ২০১৩ সনে প্রতিষ্ঠা করেছেন সেন্ট ভিনসেন্ট নার্সিং ইনস্টিটিউট যা দেশের প্রথম কোনো ক্যাথলিক নার্সিং ইনস্টিটিউট। এখান থেকে অনেক শিক্ষার্থী পড়াশোনা করে এখন দেশের বিভিন্ন সুনামধন্য হাসপাতালে চাকরি করছেন।
এ ছাড়া তিনি কৃষকরা যেন আধুনিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ করতে পারে তার জন্য একটি পুস্তিকাও রচনা করেছেন।
জানা গেছে, আগামীকাল দিনাজপুর ক্যাথিড্রালে ফাদার বেরূর্ত্তি নিথর দেহ অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া শেষে সমাহিত করা হবে।
ফাদার জুলিও বেরূর্ত্তির মৃত্যুতে গভীর শোক ও সমবেদনা জানিয়েছেন ঢাকা ক্রেডিটের প্রেসিডেন্ট পংকজ গিলবার্ট কস্তা ও সেক্রেটারি ইগ্নাসিওস হেমন্ত কোড়াইয়া। তাঁরা বলেন, ‘ ফাদার জুলিও বেরূর্ত্তির মৃত্যুতে দেশের সমবায় সমিতির বড়ো ক্ষতি হয়ে গেল। আমরা হারিয়েছি সমবায়ের একজন অভিভাবককে। তাঁর অবদানের কথা এদেশের মানুষ অনেক দিন মনে রাখবে। আমরা তাঁর বিদেহী আত্মার কল্যাণ কামনা করি। তাঁর শোকার্ত পরিবারের প্রতি জানাই গভীর সমবেদনা।’