শিরোনাম :
বিশ্ব পরিবেশ : ধেয়ে আসছে মহাবিপর্যয়
বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের বর্তমান ধারা মারাত্মক পরিণতির ইঙ্গিত বহন করছে। এ সম্পর্কে বিশেষজ্ঞদের মন্তব্য অত্যন্ত উদ্বেগের। তাদের অভিমত, জলবায়ু পরিবর্তনের চলমান ধারা অব্যাহত থাকলে বিশ্বে অচিরেই কোটি কোটি মানুষ খাদ্য ও পানীয় সংকটের মুখোমুখি হওয়ার ঝুঁকিতে পড়ে যাবে। একইসঙ্গে বাড়ছে বন্যা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকিও। বিশ্বব্যাপী প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবহারও মাত্রাতিরিক্তভাবে বেড়ে চলেছে যার প্রভাব জনস্বাস্থ্য ও উন্নয়নের প্রতিও হুমকিস্বরূপ।
পানির স্বল্পতা, মাটির ক্ষয়িষ্ণুতা, ক্রমান্বয়ে হারিয়ে যাওয়া বনভূমি, বায়ু ও পানি দূষণ এবং ক্রমহ্রাসমান সামুদ্রিক তটরেখা পৃথিবীর বহু অঞ্চলের দুর্দশার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। একদিকে উন্নত অর্থনীতির ধারক অনেক দেশই পুনঃউৎপাদনের আগেই অনেক দ্রুত সম্পদের অপচয় করছে। আবার অন্যদিকে উন্নয়নশীল দেশসমূহ ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের লক্ষ্যে নির্বিচারে শোষণ করছে প্রকৃতিকে।
ঈশ্বর ভালবেসে এই বিশ্বজগত সৃষ্টি করেছেন। “পরমেশ্বর তাঁর তৈরী সমস্ত কিছুর দিকে তাকিয়ে দেখলেন; আর সত্যিই সেই সমস্ত কিছু খুবই ভাল হয়েছে” (আদি ২: ৩১)। ঈশ্বর তাঁর এই সৃষ্টিকে ভালবাসার দানরূপে মানুষকে দিয়েছেন তার যত্ন, রক্ষা এবং কল্যানে ব্যবহার করার জন্য। তবে মানুষের দায়িত্বহীনতার ফলাফল আজকের বিপর্যস্ত পরিবেশ, পরিবর্তিত জলবায়ুু। সৃষ্টির সেরা জীব আমরা মানুষ জাতি। আর সেই শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রাখার তাগিদে মানুষ প্রকৃতির সমস্ত সৃষ্টির ওপর চালাচ্ছি নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ, একের পর এক উজাড় করছে বৃক্ষরাজি, তৃণতলা, বন-বাদাড়। নিজেদের ভাগ্য বদলাতে খাল, বিল, নদী-নালা, জলাশয়, খোলা জায়গা, মাঠ সর্বত্রই দখলদারিত্বের উলঙ্গ প্রতিযোগিতা চলছে।
পরিবেশ দূষণ আজকে শুরু হয়নি বরং শুরু হয়েছে সভ্যতার উষালগ্ন থেকেই। কারণ সভ্যতার মাপকাঠি হিসেবে যেসব জিনিসকে ধরা হয় তার প্রায় সবকিছুই কোনও না কোনওভাবে প্রকৃতিকে নষ্ট করছে। আর এর তীব্রতা আস্তে আস্তে বেড়ে (বিশেষ করে পৃথিবীব্যাপী শিল্প বিপ্লবের পর থেকে) ভয়ংকর অবস্থার রূপ নিয়েছে তাও অনেকদিন থেকেই।
বিশ্ব পরিবেশ বিপর্যয়ের সত্যকে উপলব্ধি করে ১৯৯২ সালে ব্রাজিলের রাজধানী রিও ডি জেনিরোতে, ১৯৯৬ সালে সুইজাল্যান্ডের জেনেভায়, ২০০৯ সালে ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে, ২০১০ সালে মেক্সিকোর কানকুনে, ২০১৫ সালে ফ্রান্সের প্যারিশসহ বিভিন্ন সময় বিশ্ব নেতৃবৃন্দ আলোচনায় বসেছেন। উদ্দেশ্য পৃথিবীকে সমূহ পরিবেশ বিপর্যয় থেকে রক্ষার উপায় উদ্ভাবন। তারা তা করলেন বটে এবং পৃথিবীব্যাপী তাদের উদ্ভাবিত নীতিমালা প্রয়োগ করার আহ্বান জানালেন। কিন্তু কাজের কাজ কী হলো তা বিশ্লেষণ করে দেখা যাক।
রিও ধরিত্রী সম্মেলনের প্রায় ২০ বছর পার হলেও কার্যত: কোথাও কোনও ক্ষেত্রের উন্নতি দেখা যায়না, উপরন্তু দেখা গেছে ক্রমাবনতি। বিশ্বব্যাপী ক্রমাগত পরিবেশ বিপর্যয় জনস্বাস্থ্যের প্রতি বিরাট হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। দূষিত পানি এবং নোংরা-অপরিচ্ছন্ন পয়ঃপ্রণালীর ফলেই পৃথিবীব্যাপী বছরে এক কোটি বিশ লাখেরও অধিক লোক মারা যায় এবং এর অধিকাংশই হতভাগ্য উন্নয়নশীল দেশের অধিবাসী। পরিষ্কার পানির যোগান অবশ্যই সীমিত, অথচ এর চাহিদা ক্রমাগতভাবে বেড়েই চলেছে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে। ২০২৫ সালের মধ্যে পৃথিবীর জনসংখ্যা যখন প্রায় ৮০০ কোটি হবে তখন উন্নয়নশীল দেশসমূহের ৫০-৬০% লোক পানির কষ্টে ভুগবে। এ মুহূর্তেই সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় ১৭০ কোটি লোকের মধ্যে মাত্র অর্ধেকের জন্য পরিষ্কার পানি ব্যবহারের সুযোগ আছে।
বায়ুদূষণ সারা পৃথিবীতে বছরে প্রায় ত্রিশ লাখ লোক হত্যা করে। বাংলাদেশে এ মৃত্যুর হার বছরে প্রায় ১৮,০০০ (বিশ্বব্যাংক দক্ষিণ এশিয়া রিপোর্ট ২০১৫)। সামগ্রিক পরিবেশ বিপর্য়য়ের আর একটি বড় কারণ শব্দদূষণ। উন্নয়নশীল দেশসমূহে নিয়ন্ত্রণহীনভাবে চলছে শব্দদূষণ। আমাদের রাজধানী ঢাকায় শব্দ দূষণের মাত্রা রীতিমতো ভয়ঙ্কর। কোনও কোনও স্থানে ১০৬ ডেসিবেলের ওপরে। মাথাধরা, মেজাজ খিটখিটে হওয়া, পাঠে অমনোযোগিতা এবং শ্রবণ শক্তি হারানোসহ আরও অনেক সমস্যার কারণ এই শব্দদূষণ।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা পরিচালিত এক সমীক্ষায় দেখা গেছে কমপক্ষে ৬৪টি উন্নয়নশীল দেশে জনসংখ্যা বাড়ছে খাদ্য উৎপাদনের চেয়ে অনেক দ্রুত গতিতে। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপে এ পর্যন্ত ২০০ কোটি হেক্টর আবাদী জমি বসতবাটিতে পরিণত হয়েছে, যার পরিমাণ সমগ্র উত্তর আমেরিকা মহাদেশের সমান। পরিবেশ বিপর্যয়ের ফলে পৃথিবীতে প্রায় অর্ধেক সমুদ্র উপকূলবর্তী জীবের অস্তিত্ব আজ হুমকির সম্মুখীন, আর এর বড় কারণ হচ্ছে অতিরিক্ত জনসংখ্যার ঘনত্ব এবং দ্রুত নগরায়ন।
সমুদ্রের পানি ক্রমাগত হচ্ছে দূষিত, এর মৎস সম্পদ থেকে শুরু করে তলদেশের অন্যান্য সম্পদসমূহ ক্রমান্বয়ে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। এর কারণ প্রধানত দু’টো- প্রথমত, দূষণ এবং দ্বিতীয় অতিরিক্ত আহরণ। আমাদের দেশেও এর ব্যত্যয় ঘটেনি। ছাও-পোনাসহ লাগামহীনভাবে আহরণের ফলে একদা ইলিশের দেশে এখনই এর প্রাচুর্যতা দারুণভাবে হ্রাস পেয়েছে। ফলে এরইমধ্যে দাম হয়েছে আকাশচুম্বী যা মধ্যবিত্তেরও ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গিয়েছে।
অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাহিদা মেটাতে এ পর্যন্ত পৃথিবীর প্রায় অর্ধেক বন সম্পদ নষ্ট হয়ে গেছে এবং অব্যাহতভাবে হয়েই চলেছে। প্রতি বছর প্রায় ১ কোটি ৬ লক্ষ হেক্টর বনভূমি বিলীন হয়ে যাচ্ছে- যা মোটামুটি নেপালের মোট আয়তনের সমান। উদাহরণস্বরূপ ব্রাজিলিয়ান আমাজানের কথাই যা পৃথিবীর ক্রমহ্রাসমান বনভূমিসমূহের অন্যতম। এদিকে আমাদের দেশের অবস্থাতো আরও শোচনীয়। এখানে এখন মাত্র শতকরা ১০ ভাগ বনভূমি আছে যেখানে থাকার কথা শতকরা ২৫ ভাগ। পরিবেশ ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার ফলে পৃথিবীর জীব জগতের ক্রমপরিবর্তন কৃষি ও ওষুধসহ পৃথিবীতে জীবনের অস্তিত্বই আজ হুমকিস্বরূপ।
তথাপিও মানুষ প্রতিনিয়ত হাজার হাজার জীব ও উদ্ভিদকুল ধ্বংস করে চলেছে। হিসাব করে দেখা গেছে, এ ধ্বংসের হার প্রতি তিনটি প্রজাতির মধ্যে দু’টি। আমাদের দেশেও অনেক প্রজাতি এরই মধ্যে বিলুপ্ত হয়ে গেছে এবং আরও অনেক প্রাণী বিলুপ্তির পথে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়- এক সময় বন বিড়াল এবং সজারুর দৌরাত্ম্যে হাঁস-মুরগি পালন করাই দুষ্কর ছিল। অথচ আজ এ প্রাণী দু’টো চোখেই পড়ে না। পরিবেশের ভারসাম্যহীনতার জন্য গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমনের ফলে ভূপৃষ্ঠের উষ্ণতা ক্রমশ বেড়েই চলেছে, এবং এর ফলে উত্তর গোলার্ধের গলিত বরফরাজির পানি এসে পড়ছে সাগর-মহাসাগরে এবং সমুদ্র ধেয়ে আসছে উপকূলের দিকে। বিশ্বের তাপমাত্রা যদি এভাবে বাড়তেই থাকে তাহলে প্রতি বছর পৃথিবীর নতুন নতুন এলাকা বন্যায় করালগ্রাসে হবে নিপতিত এবং এর নিম্নাঞ্চলসমূহ ধীরে ধীরে সমুদ্রগর্ভে বিলীন হতে হতে একদিন হয়তো পুরো পৃথিবীটাই বিলীন হয়ে যাবে।
তবে এই ভয়ংকর অবস্থার দিকে পৃথিবী যাতে আর না এগোয় সেজন্য আর সময় নষ্ট না করে এখনই আমাদের সচেতন হওয়া প্রয়োজন। বিশ্বব্যাপী মানুষ ও সমস্ত প্রাণীকূলের সহনীয় পরিবেশ রক্ষার জন্য নিম্নলিখিত পদক্ষেপসমূহ গ্রহণ করা যেতে পারে।
কঠোরভাবে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, সুষ্ঠু নগর পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনা, অধিকতর ময়লা-আবর্জনা সৃষ্টিকারী প্রকল্পসমূহ থেকে ভর্তুকি প্রত্যাহার এবং এসবের কাঁচামালের ওপর অধিক হারে শুল্প আরোপ করা, পানিসম্পদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা এবং বিশুদ্ধ পানির উৎসসমূহ যেকোনও মূল্যে সুরক্ষা, নদী খাল-বিলের নাব্যতা রক্ষা করা, সবধরনের জলাশয়কে দখলদারদের হাত থেকে রক্ষা করা, অপরিশোধিত কোনও বর্জ্য যেন কোনও পানিতে মিশে তা দূষিত করতে না পারে তার ব্যবস্থা করা, নদীসমূহের স্বাভাবিক গতি পরিবর্তন না করা এবং কোনও নদীতে বাঁধ না দেওয়া, অধিকতর বনভূমি সৃষ্টি এবং বর্তমান বনজসম্পদের সুষ্ঠু রক্ষণাবেক্ষণ, আবাদি জমির সুষ্ঠু রক্ষণাবেক্ষণ করে অধিকতর খাদ্য উৎপাদন, সমুদ্র উপকূলবর্তী অঞ্চলে সুরক্ষা এবং মৎস্যসম্পদের সদ্ব্যবহার, জীব ও প্রাণীকূলের আবাস এবং প্রজননস্থলের সুরক্ষা, বিশ্ব পরিবেশ রক্ষার নিমিত্তে প্রয়োজনীয় আন্তর্জাতিক আইন প্রণয়ন ও জাতিসংঘ কর্তৃক এর সঠিক প্রয়োগের ব্যবস্থা করা এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে সামগ্রিক পরিবেশ রক্ষার সুষ্ঠু নীতিমালা প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়নের দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
অত্যধিক জনসংখ্যার চাপ, বর্ধিত নগরায়ন এবং সম্পদের অপব্যবহার কোনও ক্রমেই শুভ ভবিষ্যতের ইঙ্গিত বহন করতে পারে না। সহনীয় উন্নয়নের অনুশীলন ব্যতিরেকে মানবসমাজকে আরও অধিকতর দূষিত পরিবেশের সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে বেঁচে থাকতে হবে। তবে প্রকৃতির ওপর মানুষের এই সীমাহীন অত্যাচার যখন সে আর সইতে না পারবে তখন এক সময় সে কাউন্টার এ্যাটাকে লন্ডভন্ড করে দেবে সবকিছু। জীব-বৈচিত্র্য তো দূরের কথা, পৃথিবী নামক এই সুন্দর গ্রহটিও তখন হয়তো আত্মহত্যাই করবে, তার সমস্ত সৃষ্টিকে ধ্বংস করে দিয়ে। ধেয়ে আসা এই মহাবিপর্যয়ের হাত থেকে ভবিষ্যত প্রজন্মকে তথা এই ধরিত্রীকে রক্ষার জন্য আসুন আমরা সবাই সোচ্চার হই। প্রকৃতিকে সতেজ রাখুন, সবুজ রাখুন, প্রানবন্ত করে তুলুন। কেননা আমাদের মনে রাখতে হবে- ‘‘God always forgives, man sometimes forgives, but nature never forgives.” সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ হিসেবে সৃষ্টিকে যত্ন, ব্যবহার ও রক্ষনাবেক্ষণের যে দায়িত্ব আমরা নিয়েছি তা যদি পালনে ব্যর্থ হই; তবে নিশ্চয়ই প্রভু ঈশ্বরের সুন্দর সৃষ্টি ধ্বংসের জন্য আমরাই দোষী সাব্যস্ত হবো।
লেখক :
দাউদ জীবন দাশ
ভারপ্রাপ্ত আঞ্চলিক পরিচালক, কারিতাস খুলনা অঞ্চল
dasjibon64@gmail.com
আরবি/ আরপি/ ৭ মার্চ, ২০১৭