ঢাকা ,
বার : সোমবার
তারিখ : ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
বাংলা : ৯ পৌষ ১৪৩১
Dcnewsbd Facebook
Dcnewsbd Twitter

শিরোনাম :

প্রথম পাতা ফিচার নারী তুমি কীর্তিমতি!

নারী তুমি কীর্তিমতি!

0
830

(ছবি সংগৃহীত)

(বিউটি পার্লার শিল্পের উন্নয়ন ও বিকাশে নারীদের অবদান অনেক। দেশের এই শিল্পে যে সংখ্যক কর্মজীবী নারী কাজ করেন তার শতকরা ৯০ ভাগই আদিবাসী গারো সম্প্রদায়ের। আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে বিউটি পার্লারে কর্মরত সকল কর্মজীবী নারীদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানিয়ে আমাদের এই বিশেষ আয়োজন। লিখেছেন সুমন সাংমা)

এক সময় বলা হতো রূপচর্চা আভিজাত্যের প্রতীক! সেই রূপচর্চাকে রূপসচেতন সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে কর্মজীবী এই গারো নারীদের অবদান অনেক। বিউটি পার্লার শিল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠালাভের ক্ষেত্রে তাদের অক্লান্ত পরিশ্রম রয়েছে। বাংলাদেশের এই শিল্পে যে অধিক সংখ্যক কর্মজীবী নারী কাজ করেন তার শতকরা ৯০ ভাগই গারো নারী। নিজেদের আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী করার পাশাপাশি তাদের পরিবার ও সমাজকে অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী করছেন। একই সাথে লেখাপড়া শিখিয়ে তাদের পরবর্তী প্রজন্মকেও করছেন আলোকিত। দেশের প্রবৃদ্ধিতেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছেন।

বড় বড় বিভাগীয় শহর তো বটেই দেশের অভিজাত এলাকা, বিভিন্ন জেলা ও উপজেলাগুলোতেও তাদের উদ্যোগে এই শিল্প গড়ে উঠছে ।

ঢাকাকেন্দ্রিক গারো কমিউনিটি সেন্টার (নকমান্দি)-এর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, রাজধানী ঢাকায় প্রায় পাঁচ হাজার গারো কর্মজীবী নারী বিভিন্ন পার্লারে কর্মরত আছেন। কর্মজীবী নারীদের অধিকাংশই বৃহত্তর ময়মনসিংহের। তারা পারসোনা, ফারজানা শাকিলস হেয়ার এন্ড বিউটি, ওমেন্স ওয়ার্ল্ড, সুমনস স্পা এন্ড স্কিন কেয়ার ক্লিনিক, ড্রিমস বিউটি পার্লার-এ কাজ করছেন। এছাড়াও ঢাকা শহরে ব্যক্তি মালিকানায় গড়ে ওঠা বিভিন্ন পার্লারে তাদের সরব উপস্থিতি পরিলক্ষিত হয়।

অধিকাংশ কর্মজীবী নারী কাজ করতে গিয়ে সন্তুষ্টির পাশাপাশি তাদের অসন্তুষ্টির কথাও জানিয়েছেন। রানিকা নামের একজন কর্মজীবী নারী বলেন, ‘অনেক সময় মালিকপক্ষ তাদের স্বার্থই বেশি সংরক্ষণ করে থাকে। পারিবারিক প্রয়োজনে ছুটিছাটা নেই বললেই চলে। এরপরও অফিস সময়ের অতিরিক্ত কাজ করতে হয়। সে অনুযায়ী পারিশ্রমিক পায় না, বেতনও বাড়ে না।’

কারিতাস বাংলাদেশের সহযোগিতায় পার্লারের কর্মজীবী গারো নারীদের সংগঠন সেফ প্রকল্পের সভাপতি লাকি আরেং বলেন, ‘কাজের সন্ধানে যে সব গারো মেয়ে বা মহিলা ঢাকায় আসে, সেফ প্রকল্পের আওতায় আমরা তাদের জন্য সাতদিন থাকা-খাওয়া ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করি। পাশাপাশি এই সাতদিন তাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দেওয়ারও চেষ্টা করি। যেন তারা বিড়ম্বনায় না পড়ে, সম্মান নিয়ে কাজ করতে পারে।’

ঢাকার একটি পার্লারে কর্মরত ক্যাথরিনা বলেন, ‘দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি, বাসা ভাড়া, যানবাহন খরচসহ অন্যান্য আনুষাঙ্গিক খরচও বেড়েছে কিন্তু সে তুলনায় আমাদের কর্মসংস্থানের সুবিধা বাড়েনি। বাড়ালেও প্রয়োজনের তুলনায় তা নিতান্তই কম। অনেক সময় কাজের একটু বিচ্যুতি হলে ক্লায়েন্টরা অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে, ভর্সনা করেন।’ তাদের অভিযোগ, অনেক সময় কর্তৃপক্ষ শুধু ক্লায়েন্টদের কথার ওপর ভিত্তি করে তাদের নানা কটুকথা বলেন, তাদের কথা শুনতে চান না। তখন ভীষণ খারাপ লাগে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মজীবী নারী জানান, সবাই মিলে হাসি, আনন্দে থাকি এটা ভাল লাগে। কিন্তু অনেক সময় ক্লায়েন্টদের দুর্ব্যবহার ভাল লাগে না। তখন মালিকও খারাপ আচরণ করে।

অনেক পার্লারের কর্মপরিবেশ উন্নত নয়। নিরাপত্তারও ঘাটতি রয়েছে। নানা সমস্যা ও বিপত্তি থাকা সত্ত্বেও গারো নারীরা এগিয়ে যাচ্ছেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে নকমান্দির সমন্বয়কারী প্রতাপ রেমা বলেন, ‘আমরা আইনি সহায়তাসহ তাদের দু-এক দিন আশ্রয় দিয়ে থাকি। অধিকাংশ মালিক তাদের সাথে মৌখিক চুক্তি করে, চাকরির চুক্তিপত্র দেয় না। উপরন্তু অফিস সময়ের বাইরেও কাজ করান। অতিরিক্ত কাজের জন্যে বাড়তি পারিশ্রমিক পান এমন তথ্য আমাদের জানা নেই।

রেমা আরো বলেন, প্রয়োজনেও তাদের ছুটি দেওয়া হয় না। আবাসন সমস্যাও রয়েছে। নিরাপত্তা ঝুঁকির কারণে অনেক মালিক সেই দায়িত্বও নিতে চান না। প্রথম সারির পার্লার ছাড়া অধিকাংশ পার্লারের কর্মপরিবেশ ভাল নয়। তবে তিনি মনে করেন, কর্মজীবী নারীরা গারো সমাজের অর্থনৈতিক চিত্র সম্পূর্ণ পাল্টে দিয়েছেন। তিনি অভিভাবকদেরকে তাদের মেয়েদের ঢাকায় পাঠানোর ক্ষেত্রে যথাসম্ভব নকমান্দির সাথে যোগাযোগ করে পাঠানোর পরামর্শ দেন।

এসব কর্মজীবী নারী নিজেদের প্রয়োজন মিটিয়ে অনেকেই পরিবার ও প্রিয়জনদের কাছে নিয়মিত টাকা পাঠাচ্ছেন। পরিবার ও ভাই-বোনদের পড়াশোনার খরচ জোগাচ্ছেন। অনেকেই আবার বন্ধকী জমি ছুটাচ্ছেন, জমি কিনছেন, বিল্ডিং বাড়ি করছেন। অনেকে আবার মহাজনের পাওনা ফেরত দিচ্ছেন। অনেক বাবা-মা এখন তাদের সন্তানদের নিয়ে গর্ব করেন।

একসময় পার্লারের কাজকে সমাজের অনেকেই ইতিবাচক ভাবে দেখত না। নানা কটুকথা শোনাতো। অপ্রিয় হলেও সত্য একসময় পার্লারে কর্মজীবী নারীদের জন্যে পাত্রের অভাব হতো। দিন পাল্টেছে। এখন অনেক অভিভাবক তাদের ছেলের বউ করার জন্যে মেয়ের পরিবারের কাছে প্রস্তাব পাঠাচ্ছেন। যদি বিউটি পার্লার আজকে শিল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে, তবে গারো কর্মজীবী নারীদের নাম এই শিল্পের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।

যাদের শ্রমে-ঘামে বিউটি পার্লার আজ শিল্প হয়েছে, মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছেছে সেই গারো কর্মজীবী নারীরা চান তাদের শ্রমের যথাযথ সম্মান ও মূল্য কর্তৃপক্ষ দিক। উন্নত কর্মপরিবেশ ও যুগের সাথে সঙ্গতি রেখে তাদের বেতন এবং সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো হোক। পাশাপাশি কর্তৃপক্ষ তাদের প্রতি আরো সহনশীল ও মানবিক হবে এটাই তাদের প্রত্যাশা।

এসএস/আরপি/আরবি/৭ মার্চ, ২০১৭