শিরোনাম :
বাংলাদেশ ওয়াইএমসিএ’র ইতিহাসে প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট মার্সিয়া মিলি গমেজ
ডিসিনিউজ ।। ঢাকা
পৃথিবী এগিয়ে গেছে, সেই সাথে এগিয়ে গেছে মানুষের মানসিকতা। পুরানো প্রথা ভেঙ্গে নারী-পুরুষের অধিকার ও অবদান এখন সমান। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ এখন মানতে বাধ্য একজন নারী হলেন সমাজের দর্পন, সর্বজয়া, কান্ডারী এবং স্রষ্টা। একজন নারী যেমন স্রষ্টার সুন্দর সৃষ্টি হয়ে জন্ম নেন এবং তার মধ্যে স্নেহ, মায়া, মমতা এবং মাতৃত্বের অপার সৌদর্য্য ধাবিত হয়, তেমনি অন্যায়ের বিরুদ্ধে হতে পারেন তেজস্বয়ী মূর্তি। সারা বিশ্বে পুরুষশাসিত প্রথা ভেঙ্গে এখন নারীরাও পুরুষের পাশাপাশি সবকিছুতেই সমান ভূমিকা রাখছেন। রূপকার থেকে শুরু করে নেতৃত্বের ধারায়ও নারীদের অবদান এখন জাজ্জ্বল্যমান। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও নারীরা এখন বিভিন্নভাবে অবদান রাখছেন। বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, জাতীয় সংসদের স্পীকারসহ বিভিন্ন সরকারী ও বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে নারীরাই নেতৃত্ব দিচ্ছেন। বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকেই অসংখ্য প্রগতিশীল নারী বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান রেখেছেন। তেমনি একজন প্রগতিশীল নারী হলেন মার্সিয়া মিলি গমেজ। যিনি নিজে যেমন পুরুষতান্ত্রিক বাধা পার করে নেতৃত্বের ধারায় এসেছেন, তেমনি অন্য নারীদের ক্ষমতায়ন ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় প্রত্যক্ষ ভূমিকা রেখে চলেছেন। তিনি প্রান্তিক পর্যায় সংগঠনের সাথে যুক্ত হয়ে এখন সুবিশাল পরিসরে নেতৃত্বে দিয়ে যাচ্ছেন।
স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে নারীর ক্ষমতায়ন, সমাজ উন্নয়ন, লিঙ্গ বৈষম্য দূরীকরণের কাজ করে আসছেন প্রায় ৩৫ বছর ধরে। (ছবি: মার্সিয়া মিলি গমেজের ফেইসবুক সৌজন্যে)
মার্সিয়া মিলি গমেজ বাংলাদেশ ওয়াইএমসিএ’র পঞ্চাশ বছরের এবং ভারত উপমহাদেশের ওয়াইএমসিএ’র ১৭০ বছরের ইতিহাসে ওয়াইএমসিএ’র জাতীয় পরিষদে প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন।
ঢাকার অদূরে সাভারের বাংলাদেশ ওয়াইএমসিএ’র আন্তর্জাতিক কনফারেন্স হলে ২৭ জানুয়ারি, ২০২৪ ওয়াইএমসিএ-এর জাতীয় কাউন্সিলের ৪৫তম বার্ষিক সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত হয়। একই দিনে বার্ষিক সাধারণ সভার পরে সংগঠনটির নির্বাহী কমিটির নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
ওয়াইএমসিএ’র নির্বাচনে ২০২৩-২০২৫ মেয়াদে সাভার ওয়াইএমসিএ-এর প্রতিনিধি মার্সিয়া মিলি গমেজ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জাতীয় ওয়াইএমসিএ-এর প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন।
নারীদের উৎসাহীত করে মার্সিয়া মিলি গমেজ নারী জাগরণে নিয়মিত কাজ করে যাচ্ছেন (ছবি: মার্সিয়া মিলি গমেজ সৌজন্যে)
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের জন্মের বছরেই মার্সিয়া মিলি গমেজের জন্ম। বরিশাল জেলার সম্ভ্রান্ত পরিবারের স্বর্গীয় জন জ্যোর্তিম্ময় বাড়ৈ ও স্বর্গীয়া বিথীকা বাড়ৈ’র মেয়ে মার্সিয়া মিলি গমেজ জন্ম থেকেই ঢাকার রাজাবাজার এলাকায় মানুষ হয়েছেন। অনেক চড়াই-উৎড়াই পার করে, সংগ্রামের মধ্যদিয়ে বাঙালি জাতি যেমন স্বাধীনতা অর্জন করেছে, গমেজও তেমনি শত বাধা বেরিয়ে, পুরুষশাসিত সমাজের পুরানো ধারার সামাজিক রীতিনীতি ভেঙ্গে নারীর ক্ষমতায়নের জন্য কাজ করে সাফল্যের শিখড়ে পৌঁছেছেন।
মিসেস গমেজ ছাত্র জীবন থেকেই বিভিন্নভাবে ধর্মীয় এবং সামাজিক কর্মকান্ডের সাথে যুক্ত ছিলেন। নারী নেতৃত্ব থেকে শুরু করে বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও জাতীয় উন্নয়ন সংগঠনগুলোর সাথে কাজ করেছেন। তিনি স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে নারীর ক্ষমতায়ন, সমাজ উন্নয়ন, লিঙ্গ বৈষম্য দূরীকরণের কাজ করে আসছেন প্রায় ৩৫ বছর ধরে।
এপিএওয়াই-এর ১৩তম, ১৯তম ওয়াইএমসিএ-এর কাউন্সিলে এবং ১৫তম, ১৯তম এবং ২০তম ওয়াইএমসিএ-এর ওয়ার্ল্ড কাউন্সিলের সাধারণ অধিবেশনেও সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। (ছবি: মার্সিয়া মিলি গমেজের ফেইসবুক সৌজন্যে)
১৯৮৮ সালে, কলেজ জীবন থেকে মার্সিয়া মিলি গমেজ ওয়াইএমসিএ’তে যোগ দেন। শত বাধা পেরিয়ে এবং সমাজে নারীর অবদানকে জাগ্রত করতে ধীরে ধীরে স্থানীয় ওয়াইএমসিএ থেকে জাতীয় এবং পরবর্তিতে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে একজন স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করেছেন। তিনি বাংলাদেশ ওয়াইএমসিএ-এর প্রথম ইয়ূথ ক্লাবের প্রথম সেক্রেটারি এবং বাংলাদেশ ওয়াইএমসিএ’র প্রথম ইয়ূথ কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন এবং বাংলাদেশে ওয়াইএমসিএ’র প্রথম পূর্ণ নারী সদস্যপদ লাভ করেন।
মিসেস গমেজ বাংলাদেশের ওয়াইএমসিএ’র জেন্ডার ও যুব স্টাস্কফোর্সের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ছিলেন এবং দেশের বিভিন্ন স্থানে আঞ্চলিক ওয়াইএমসিএগুলোতে যুব জেন্ডার কমিটি তৈরিতে বিশেষ অবদান রেখেছেন। পরবর্তীতে ২০১২-২০১৪ মেয়াদে জাতীয় ওয়াইএমসিএ’র জেন্ডার কমিটির প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
জেন্ডার বৈষম্য দূরীকরণে মার্সিয়া মিলি গমেজ সব বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। (ছবি: মার্সিয়া মিলি গমেজ সৌজন্যে)
মিসেস গমেজ আন্তর্জাতিকভাবে ১৯৯১-১৯৯৫ সাল পর্যন্ত ওয়াইএমসিএ-এর এশিয়া এ্যালায়েন্সের প্রথম জেন্ডার এন্ড ইয়ূথ স্টাস্কফোর্স গ্রুপের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৯-২০২৩ সাল পর্যন্ত তিনি এপিএওয়াই’র জেন্ডার সমতা কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
মিসেস গমেজ এশিয়ান প্যাসিফিক এ্যালায়েন্স অব ওয়াইএমসিএ (এপিএওয়াই)-এর ‘জেন্ডার জাস্টিস পলিসি’ প্রণয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন এবং এপিএওয়াই’র প্রথম তিন দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত জেন্ডার ইকুয়্যাটি ফোরাম আয়োজনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
এশিয়ান প্যাসিফিক এ্যালায়েন্স অব ওয়াইএমসিএ (এপিএওয়াই)-এর ‘জেন্ডার জাস্টিস পলিসি’ প্রণয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন তিনি (ছবি: মার্সিয়া মিলি গমেজ সৌজন্যে)
তিনি এপিএওয়াই-এর ১৩তম, ১৯তম ওয়াইএমসিএ-এর কাউন্সিলে এবং ১৫তম, ১৯তম এবং ২০তম ওয়াইএমসিএ-এর ওয়ার্ল্ড কাউন্সিলের সাধারণ অধিবেশনেও সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন।
মিসেস গমেজ একটি স্বনামধন্য ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে শিক্ষক হিসেবে পেশাগত জীবন শুরু করেন। পরবর্তীতে বেসরকারী ও আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা এবং গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের ইমপ্যাক্ট প্রকল্পে দারিদ্র্য বিমোচন, সামাজিক উন্নয়ন, ক্ষুদ্র ঋণ, নারী উদ্যোক্তা প্রশিক্ষণ, নারী ক্ষমতায়নসহ মানব সম্পদ উন্নয়নে একজন দক্ষ উন্নয়ন পেশাজীবী কর্মী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। বর্তমানে মার্সিয়া মিলি গমেজ তাদের পারিবারিক ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান এমএম ইন্টারন্যাশনালে ফিন্যান্স এন্ড অ্যাডমিন চিফ হিসেবে কাজ করছেন যা বাংলাদেশের একটি পরিবহন ও লজিস্টিক সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে সুপরিচিত। তাঁর পেশাগত জীবনের অভিজ্ঞতা পঁচিশ বছরের উর্ধ্বে।
একজন নিবেদিত প্রশিক্ষক হিসেবে মার্সিয়া মিলি নারীর ক্ষমতায়ন, জেন্ডার, যুব নেতৃত্ব বিকাশ ও সেইসাথে খ্রিষ্টীয়ান নেতৃত্বের প্রশিক্ষণ দিয়ে যাচ্ছেন।
পেশাগত এবং সমাজ উন্নয়নে যেমন তিনি উজ্জ্বল, তেমনি শিক্ষা জীবনেও তিনি প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। ঢাকার স্বনামধন্য হলিক্রস কলেজ হতে এইচএসসি পরীক্ষায় ঢাকা বোর্ডের অধীনে তিনি সম্মিলিত মেধা তালিকায় স্থান করে নিয়েছিলেন, প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে অনার্স এবং মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। এ ছাড়াও তিনি পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষে বাংলাদেশ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে (ব্যাচেলর অব এডুকেশন) বিএড ডিগ্রি সফলতার সাথে অর্জন করেন।
আন্তর্জাতিক কাউন্সিলগুলোতে সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে তিনি নিজেকে অভিজ্ঞতায় পরিপূর্ণ করে তুলেছেন। (ছবি: মার্সিয়া মিলি গমেজের ফেইসবুক সৌজন্যে)
পেশাগত, সমাজ উন্নয়ন ও নারীর ক্ষমতায়নের পাশাপাশি মার্সিয়া মিলি গমেজ একজন সচেতন ও দক্ষ গৃহিনীও। মেয়ে রাত্রি মিশেল ও ছেলে অভিষেক ইম্মানুয়েল গমেজ উচ্চশিক্ষার জন্য দেশের বাইরে অবস্থান করছেন। মার্সিয়া মিলি ঢাকা ক্রেডিটের প্রাক্তন সফল প্রেসিডেন্ট ও এশিয়া প্যাসিফিক ওয়াইএমসিএ-এর প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট বাবু মার্কুজ গমেজের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ।
সহধর্মী বাবু মার্কুজ গমেজ, মেয়ে রাত্রি মিশেল গমেজ ও ছেলে অভিষেক ইম্মানুয়েল গমেজকে নিয়ে সুখি পরিবার মার্সিয়া মিলি গমেজের। (ছবি: মার্সিয়া মিলি গমেজের ফেইসবুক সৌজন্যে)
বর্তমানে তিনি বাংলাদেশ খ্রীষ্টান এসোসিয়েশনের নারী কমিটির আহ্বায়ক, বাংলাদেশ হাগাই ইনস্টিটিউট অ্যালামনাই এ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এবং দি খ্রীষ্টান কো-অপারেটিভ ক্রেডিট ইউনিয়ন লি:, ঢাকা (ঢাকা ক্রেডিট)-এর মহিলা কমিটির সহ-আহ্বায়কের দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি রাজাবাজার খ্রীষ্টান কল্যাণ সমিতির প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এ ছাড়াও, রাজাবাজারে স্থানীয় নারী, যুব ও বয়স্ক ব্যক্তিদের আধ্যাত্মিক উন্নয়নে চ্যাপেল নির্মাণের জন্যও অবদান রেখেছেন।
তিনি বাংলাদেশের পঞ্চাশ বছরের ইতিহাসেই শুধু নয়, ১৮৫৪ সালে ইন্ডিয়া সাব-কন্টিনেন্ট-এ ওয়াইএমসিএ প্রতিষ্ঠার পর ওয়াইএমসি জাতীয় পরিষদের প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট হিসেবে প্রতিষ্ঠানটির নেতৃত্ব দিবেন।