শিরোনাম :
একাত্তরের অগ্নিঝরা মার্চ
বীরমুক্তিযোদ্ধা ও বিজিবির অবসরপ্রাপ্ত মেজর বিজয় ম্যানুয়েল পেরেজ
বিজিবির অবসরপ্রাপ্ত মেজর ও বীরমুক্তিযোদ্ধা বিজয় ম্যানুয়েল পেরেজ-এর জন্ম ১৯৫৪ সালে, ঢাকার ফার্মগেইটে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন ১৮ বছরের এক তরুন, পড়তেন তিতুমীর কলেজে, এইচএসসি প্রথম বর্ষে। ছিলেন প্রচন্ড নির্ভীক এক যোদ্ধা। যুদ্ধ করেছেন ২নং সেক্টরে। স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব রক্ষায় এবং দেশ-মাতৃকার টানে জীবন বাজি রেখে রণাঙ্গনে যুদ্ধ করেছেন। পরবর্তীতে বিজিবির মেজর হিসেবে অবসরে যান। কেমন ছিল মার্চের সেই উত্তাল দিনগুলো, সে কথাই তিনি জানিয়েছেন ডিসি নিউজের পাঠকদের জন্য। পাঁচ পর্বের ধারাবাহিকের পঞ্চম ও শেষ পর্ব ছাপা হল আজ। সম্পাদনা সুমন সাংমা।
(পূর্ব প্রকাশের পর)
২৭ মার্চ, রাত বারোটা কী একটা। তখনও সৈন্যদের টহলের আনাগোনা লক্ষ্য করছি। একদিকে ভাল ছিল এই জন্য বাইরে কারফিউ থাকলেও তখন পর্যন্ত মিলিটারী টহলরত কোনো গাড়ি মেইন রোড ছেড়ে গলির ভেতর ঢুকেনি। গোপনে গলির মুখে মেইন রোডের কাছে এসে পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করলাম। রাত ৩টার দিকে নিরব-নিস্তব্ধ হওয়ার পর খুব সাহস করে ছয় বন্ধু ও দাদাসহ কড়াত নিয়ে পূর্ব নির্ধারিত গাছের কাছে আসলাম। দুপাশে দুজন পাহারায় বসালাম।
যেহেতু বয়সে সর্বকনিষ্ঠ ছিলাম, তাই আরেকজনকে নিয়ে (যার নাম আজ আর মনে নেই) গাছের গোড়ায় কড়াত ধরলাম এবং যথারীতি কাটতে শুরু করলাম। এভাবে প্রায় ভোর ৫টা পর্যন্ত গাছ কাটতে লাগলাম। কিন্তু গাছের অর্ধেকও সেদিন কাটতে পারিনি। কারণ, টহলের গাড়ি আসলেই দৌঁড়ে পালাতে হতো। ওরা চলে গেলে আবার শুরু করতাম। এভাবে রাত জেগে আমাদের গাছ কাটতে হয়েছে।
অবশেষে পরের দিন, ২৮ মার্চ রাত ২টার সময় গাছটি কেটে রাস্তার উপর ফেলি। গাছ পড়ার পরে বিকট এক আওয়াজ হল। আমরা কড়াতসহ দৌঁড়ে গলির পেছন দিয়ে পুরাতন বিমান বন্দর স্টাফ কোয়ার্টারে এক আত্মীয়ের বাসায় গিয়ে আশ্রয় নেই। তখন প্রায় ভোর। এত ভোরে আমাদের দুজনকে দেখে আন্টি চমকে উঠলেন। আমরা ওই অপারেশনের কথা তাকে আর কিছুই বলিনি। নিজের তেজকুনী পাড়ার বাসায় না যাওয়ার কারণ হলো যদি পাক-সেনারা ঐ এলাকার আশেপাশের বাসায় গিয়ে তল্লাশি করে! খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম ৪-৫ দিন ওই রোডে যান চলাচল বন্ধ ছিল এবং মিলিটারীরা পরের দিন ওই এলাকার ঘরে ঘরে তল্লাশি চালিয়েছে। অনেক মানুষকে মারধর করেছে এবং কিছু লোকজনকে ধরেও নিয়ে গেছে যাদের পরে ছেড়ে দেয়। ওই অপারেশনের পর আমি আর কসমসদা উত্তরার উত্তরখানে আমাদের বাড়িতে চলে আসি। মাঝে মাঝে আমি আর দাদা তেজকুনীপাড়ার বাসায় এসে থাকতাম আর ঘর পাহারা দিয়ে গ্রামের বাড়ি ফিরে যেতাম।
আমার নিকটাত্মীয় আঙ্কেল ও আন্টি বিমানবন্দর স্টাফ কোয়ার্টারে থাকতেন। তাদের ছেলে (আমার সমবয়সী) শাহীন স্কুলের এসএসসি পরীক্ষার্থী ছিল। সে আমাদের বাড়িতেই থাকত। তার সাথে একদিন আলাপ করতে গিয়ে জানতে পারলাম, টিনের কৌটা দিয়ে বা বোতলে বারুদ ঢুকিয়ে সে ককটেল তৈরি করতে পারে। আমি তাকে অনুরোধ করে বললাম, তুমি চল আমার সাথে। তোমাকে বোতল ও আনুষাঙ্গিক জিনিস জোগার করে দেই, কিছু ককটেল তৈরি করে দেবে। সে রাজি হলো এবং দুটি বোতলের ককটেল বানিয়ে দিল।
তেজকুনীপাড়ার বাসায় ফেরার সময় কসমসদা আর আমি ককটেলটি গোপনে ব্যাগে করে নিয়ে আসি। এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে কারওয়ান বাজারে বাজার করতে এসে ব্যাগের ভেতর একটি ককটেল নিয়ে যাই। সেখানে প্রায়শই ভ্রাম্যমান সেনা টহল গাড়ি স্থির দাঁড়িয়ে থাকতে দেখতাম। আমরা কারওয়ান বাজার ফিশারি অফিসের গলির মুখে দেখতে পেলাম টহলগাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। দু-একজন সৈন্য নিচে নেমে ঢিলেডালা অবস্থায় ঘোরাফেরা করছে। তখনই স্থির করলাম, ওদের গাড়িতে আজ ককটেল ছুঁড়ে মারব। বার বার সুযোগ খুঁজতে লাগলাম আর একসময় পেয়েও গেলাম।
গাড়ির পেছনে সৈন্য দেখা যাচ্ছে। তারা পেছন থেকে আমাকে আঘাত করতে পারে। আমি সরাসরি গাড়ির সামনে চলে গেলাম। লক্ষ্য করলাম ওরা আমাকে দেখতে পাচ্ছে না আর ড্রাইভারও সামনের সিটে বসা নেই। তাৎক্ষনিকভাবে নিরাপদ অবস্থান নিয়ে ব্যাগ থেকে বোতল বের করে স্বজোরে সামনে উইনসিল্ড গ্লাসে নিক্ষেপ করে পাশের বিল্ডিং-এর কোনায় লুকিয়ে পড়লাম। তীব্র আওয়াজে মুহুর্তে গাড়ির গ্লাস ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেল।
মানুষজন ছুটোছুটি করছে। সৈন্যরা ফায়ারিং শুরু করে দিল। আমরা ভিড় সামলে নিরাপদে পালিয়ে গ্রামের বাড়িতে চলে আসি। পরে জানতে পারি তিন পাক-সেনা সেদিন গুরুতর আহত হয়েছিল। একজনের চোখ দুটি নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। গাড়ির ইঞ্জিনে আগুন ধরেছিল। এ নিয়ে পত্রিকাতেও খবর বেরিয়েছে। উত্তরখানের বাড়িতে আসার পর অনেক দিন আর ঢাকা শহরে যাইনি। অত্যাচারী, স্বৈরশাসকগোষ্ঠীর সৈন্যদের আঘাত করতে পেরেছি। তাই মনে অনেকটা শান্তি পেয়েছিলাম। তারপরও সেদিনের রোকেয়া হলের লাশের কথা মনে হলে এই বয়সে এসে স্থির থাকতে পারি না। তখন মনে হতো, ওদের মতো আমাদের হাতেও অস্ত্র থাকলে প্রতিদিন ওদের বুক ঝাঝড়া করে দিতাম। বাড়িতে মোটেও ভাল লাগছিল না।
একদিন সন্ধায় রেডিওতে বিবিসির খবরে শোনলাম সীমান্ত এলাকার হাজার হাজার তরুণ দলেদলে ট্রেনিং নিতে ভারতে যাচ্ছে। এই খবর শুনে আর স্থির থাকতে পারলাম না। উল্লাসে ফেটে পরলাম। উত্তরার আশেপাশের এলাকায় খোঁজ নিতে লাগলাম কীভাবে ভারত যাওয়া যায়। (সমাপ্ত)
এসএস/আরপি/২৮ মার্চ, ২০১৭