ঢাকা ,
বার : সোমবার
তারিখ : ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
বাংলা : ৯ পৌষ ১৪৩১
Dcnewsbd Facebook
Dcnewsbd Twitter

শিরোনাম :

প্রথম পাতা ফিচার সিঁড়ি দিয়ে উঠার সময়ও মনে হচ্ছিলো যেন পুরো ভবন কাঁপছে

সিঁড়ি দিয়ে উঠার সময়ও মনে হচ্ছিলো যেন পুরো ভবন কাঁপছে

0
628
ছবি: ইন্টারনেট

বেশি দিন কাটেনি। হয়তোবা ক্ষত সেরে গেছে অর্থলোভী কিছু মালিকদের। ক্ষত কি শুকিয়েছে বাঙালি জাতির, সেদিনের সেই ভয়াভহ ধ্বংসযজ্ঞের। যার যাই-ই হোক তাদের কি ক্ষত কোনো দিনও শুকাবে, যারা সেইদিনের স্বার্থলোভী ঝুঁকির বলি হয়েছেলি! হারিয়েছে নিজের হা, পাসহ বিভিন্ন অঙ্গ। আর স্বজন হারানোর ব্যাথাইবা জাতি ভুলবে কি করে।

সাভার বাসস্ট্যান্ডের পূর্ব পাশে চার বছর আগে ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সকালে রানা প্লাজা নামক বহুতল বাণিজ্যিক ভবনটি ধসে পড়ে। মৃত্যুবরণ করেন ১ হাজার ১৩৬ জন শ্রমিক। আর আহত হয় হাজারো শ্রমিক। এদের মধ্যে আজ অনেকেই পঙ্গু। সাভার বাসস্ট্যান্ডের পূর্ব পাশে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের পাশে ছিল রানা প্লাজা। ভবনটি ছিল ৯ তলা। তৃতীয় থেকে অষ্টম তলা পর্যন্ত ছিল পোশাক কারখানা। নিচের ২ টি তলায় ছিল মার্কেট ও ব্যাংক। আর নবম তলা ছিল নির্মাণাধীন। ভবনটিতে ছিল ৫ টি পোশাক কারখানা, মার্কেট, ব্যাংক আর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কার্যালয়।

ছবি : ইন্টারনেট
ছবি : ইন্টারনেট

ধসই ছিল বিশ্বের শিল্পক্ষেত্রে অন্যতম ভয়াবহ একটি দুর্ঘটনা। ঘটনা স্থল থেকে যারা জীবিত উদ্ধার হয়েছিলেন, তারা জীবন ফিরে পেয়েছেন ঠিকই কিন্তু আজো ফিরে পাননি তাদের স্বাভাবিক জীবন। অনেকে হারিয়েছেন তাদের আপন জন, সহকর্মী। কেউবা হারিয়েছেন তাদের কাজ করার বা চলার ক্ষমতা, আর হারিয়েছেন তাদের সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতকে।

বীভৎস সেই দিনের স্মৃতি মনে পড়লে আজো আঁতকে উঠেন জীবন ফিরে পাওয়া শ্রমিকেরা। ভবনে আগের দিন ফাটল দেখা দেওয়ার কারণে পোশাক কারখানার শ্রমিকদের ছুটি দেওয়া হয়। ভবনে ফাটলের ভয়ে পরদিন শ্রমিকেরা কাজে যোগ দিতে চান নি। ভবনের কিছু হয়নি বলে শ্রমিকদের কাজে যোগ দেওয়ার জন্য বাধ্য করেন মালিকেরা। তারা বলেন, আগামী কয়েক বছরেও এই ভবনের কিছু হবে না। বেতনের ভয়ে আর চাকরীচ্যূত হওয়ার ভয়ে জীবন বাজি রেখে শ্রমিকেরা প্রবেশ করেন মরণফাঁদে। সকালেই শুরু হয় কাজ। আধা ঘণ্টা পরেই ধসে পড়ে রানা প্লাজা ভবন। ঘটে ইতিহাসে দেশের সবচেয়ে বড় শিল্প বিপর্যয়। শিরোনাম হয় দেশ ও আন্তর্জাতিক সকল গণমাধ্যমের।

ঘটনাস্থল থেকে জীবন ফিরে পাওয়া ২১ বছর বয়সী আয়েশা আক্তার আজো সেই দিনের কথা ভুলতে পারেন নি। আয়েশা কাজ করতেন ৭ম তলায়। ধংসস্তুপের নিচ থেকে উদ্ধার পেয়েছিলেন ১১ ঘণ্টা পর। উদ্ধার করার পর তিনি জ্ঞান হারান, আর নিজেকে চিনতে পারেন নি, এমন কি নিজের নামটিও ভুলে গিয়েছিলেন। তিনি ডিসিনিউজকে বলেন সেই ভয়ঙ্কর দিনের কথা।

তিনি বলেন,”আগের দিন দেওয়ালে ফাটল দেখার জন্য আমাদের ছুটি দেয়। কিন্তু পরেরদিন আমাদের মালিক বলে যে কাজ না করলে বেতন দিবে না। চিন্তা করলাম  খিদার পেট, বেতন না দিলে পেট চলবে কিভাবে? তাই ভাবলাম যাই। সিঁড়ি দিয়ে উঠার সময়ও মনে হচ্ছিলো যে পুরো ভবন কাঁপছে। কাজ শুরু করার একটু পরেই কারেন্ট চলে যায়। এরপর জেনারেটর চালানোর সাথে সাথেই ধসে পড়ে পুরো ভবন। আমার সামনেই ভেঙে পড়ে একটি বড় দেয়াল। আর অল্প একটু জায়গায় আমরা আটকে পড়ি ১০/১২ জন। আমার একজন সহকর্মী ভয়ে বাক শক্তি হারিয়ে ফেলেন। আমরা অন্ধকারে কিছু দেখতে পারছিলাম না। পানি পিপাসায় অনেক কষ্ট পেয়েছিলাম। উদ্ধারকর্মীরা আমাদেরকে ১১ ঘণ্টা পর লোহা কেটে বের করেন। তারপর আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। হাসপাতালে জ্ঞান ফেরার পর নিজের নামটিও মনে করতে পারছিলাম না। এখন সরকারের দেওয়া কিছু অর্থ দিয়ে একটি দোকান দিয়েছি। সেই টাকা দিয়েই জীবন চালাই। কিন্তু এখনো আমি আগের মত স্বাভাবিক জীবন যাবন করতে পারছি না। আগের মতো আর হাসতে পারি না।”

ঘটনাস্থল থেকে ৩ দিন পর জীবন ফিরে পাওয়া মমতাজ বেগম ডিসিনিউজকে বলেন, “আমরা ২০/২৫ জন ছিলাম, ১০/১২ জন বেঁচে ছিলাম শেষ পর্যন্ত আর বাকিরা মারা যায়। দুই দেওয়ালের মাঝে  অল্প জায়গায় আমরা শোয়া অবস্থায় ছিলাম, একভাবেই শুয়ে ছিলাম ৩ দিন, নড়াচড়া করার উপায় ছিল না। আমরা এমন এক জায়গায় ছিলাম যেখানে আমাদের খোঁজ খবরই পাচ্ছিলো না উদ্ধারকর্মীরা। ভেবেছিলাম আমাদের আর বাঁচার আশা নেই। পরে উদ্ধারকর্মীরা ছাঁদ ফুটো করে আমাদের উপস্থিতি জানতে পারে। এরপর তারা আমাদের উদ্ধার করেন। এখন সুস্থ আছি কিন্তু এখন আর আগের মতো কাজ করতে পারি না। কোমড় ব্যাথার জন্য বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকাও সম্ভব না।“

ছবি : ইন্টারনেট
ছবি : ইন্টারনেট

এভাবে সেদিন রানা প্লাজার ধংসস্তুপের নিচ থেকে ফিরে আসা ক্ষতিগ্রস্তদের নিয়ে কাজ করে বেশকিছু সামাজিক সংগঠন এবং উন্নয়ন সহযোগি প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে কারিতাস বাংলাদেশ একটি। কারিতাস ঢাকা অঞ্চল রানা প্লাজা ধসের ক্ষতিগ্রস্তদের নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। রানা প্লাজায় ক্ষতিগ্রস্তদের নিয়ে কাজ করা কারিতাস কর্মী অনন্যা রহমান জানান, কারিতাস ঢাকা অঞ্চল রানা প্লাজা ধসের ক্ষতিগ্রস্তদের নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। তাদের এবং তাদের সন্তানদের শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবাসহ অল্পকিছু আর্থিক সহযোগিতাও প্রদান করা হয়েছে। এখনো কারিতাসে এই প্রকল্পের কাজ অব্যাহত রয়েছে।

এরকম আয়েশা এবং মমতাজরা আজো ঝুঁকি নিয়ে কাজ করে বিভিন্ন স্থানে। বছর ঘুরে বছর আসে। ক্যালেন্ডারের পাতা পাল্টায়, কিন্তু ক্ষত মুছে যায়নি সেদিনের মৃত্যু থেকে ফিরে আসা আয়েশাদের।

আরবি/আরপি/২৫ এপ্রিল, ২০১৭