শিরোনাম :
স্বপ্নের সংসার !
জুয়েল স্বর্ণালীর প্রতিটি কথা এভাবে রাখবে এটা স্বার্ণালী ভাবতেই পারেনি। জুয়েল স্বর্ণালীকে ভালবাসে এটা সত্যি কিন্তু এতটাই ভালবাসবে সেটা স্বর্ণালী জানত না। স্বর্ণালীর প্রতিটি স্বপ্নের দাম দিয়েছে জুয়েল।
আজ জুয়েলের ঘরে স্বর্ণালীর প্রথম দিন। সদ্য বিবাহিত দুজন। ভালবাসার বিয়ে তাদের। গতকাল বিয়ে হয়েছে ওদের। বাড়িতে অনেক আত্মীয়-স্বজন, হৈচৈ, দারুন একটা পরিবেশ।
ঘুম ভাঙ্গতেই জুয়েল স্বর্ণালীকে খুঁজছিল, কোথাও দেখা যাচ্ছিল না, কাউকে জিজ্ঞাসাও করতে পারছিল না জুয়েল। হঠাৎ রান্নাঘরের দিকে তাকাতেই দেখল স্বর্ণালী চা বানাচ্ছে। জুয়েলের মনটা খুশিতে ভরে গেল। দৌঁড়ে রান্না ঘরে গিয়ে স্বর্ণালীকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরল। স্বর্ণালী ভয়ে, লজ্জায়, আনন্দে কেঁপে উঠছিল। ভালবাসার মানুষের স্পর্শ যে এত মধুর হয়, সেটা স্বর্ণালী এখন টের পেল। তাড়াতাড়ি নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল এসো চা খাব সবাই অপেক্ষা করছে।
সবাই এক সাথে বসে চা খাচ্ছে আর নতুন বউয়ের প্রশংসা করছে। এত গুনবতী বউ এনেছে জুয়েল যে সবাই খুশি। বিশেষ করে জুয়েলের বাবা মা। স্বর্ণালী দেখতে ভারী মিষ্টি। সব সময় মুখে হাসি লেগেই থাকে। আর সবাইকে খুব তাড়াতাড়ি আপন করে নিতে পারে। জুয়েল এই হাসি দেখেই ভালবেসেছে স্বর্ণালীকে। ২ বছর আগে একটা অনুষ্ঠানে পরিচয় হয় দুজনের। অনুষ্ঠানের মধ্যেই দুজনের চোখে চোখ পড়ে। জুয়েল অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো। স্বর্ণালী খুব লজ্জা পাচ্ছিল আবার ভালও লাগছিল। খোলা মাঠে অনুষ্ঠান হচ্ছিল। পড়ন্ত বিকেলে মিষ্টি হাওয়া দোল দিয়ে যাচ্ছিল আর স্বর্ণালীর খোলা চুলগুলো এলোমেলো উড়ছিল। অদ্ভুত সুন্দর দেখাচ্ছিল স্বর্ণালীকে, জুয়েল কোনোভাবেই চোখ ফেরাতে পারছিল না।
হঠাৎ করেই দমকা হাওয়া সব লন্ডভন্ড করে দিল। আচমকা ঝড় শুরু হল। সবাই দৌঁড়াদৌঁড়ি শুরু করছিল। স্বর্ণালী পরিচিত জনদেরও খুঁজে পাচ্ছিল না। ভীষণ কান্না পাচ্ছিল স্বর্ণালীর, দিশেহারা সে, কি করবে এখন? প্রচন্ড বেগে বৃষ্টি হচ্ছে, সাথে বজ্রপাত। স্বর্ণালী অনেক ভয় পেত বজ্রপাতকে। ভয়ে জড়সড় হয়ে প্যান্ডেলের এক পাশে বসে কাঁদছে, ঠিক তখনই জুয়েল এসে স্বর্ণালীকে ডাক দিল। হ্যালো আপনি কি ভয় পেয়েছেন?
স্বর্ণালী জোড়ে কেঁদে উঠল আর জুয়েলকে জড়িয়ে ধরল। জুয়েল হতভম্ব হয়ে গেল কি করবে সে, মাত্র কয়েক মিনিটের দেখা। স্বর্ণালীকে ধরতেও পারছে না আবার ছাড়তেও পারছেনা। জুয়েল চুপ করে রইল। একদম হঠাৎ করেই স্বর্ণালী বুঝতে পারল সে কাউকে জড়িয়ে আছে। লজ্জায় লাল হয়ে গেল। সরিবলে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল। জুয়েল বুঝতে পেরে বললো, আমি জানি আপনি ভয় পেয়ে এমন করেছেন। সরিবলতে হবে না।
আমি জুয়েল, আপনি? আমি স্বর্ণালী। বান্ধবীদের সাথে এসে ছিলাম কিন্তু ওরা আমাকে একা ফেলে সবাই চলেগেছে। জুয়েল বললো, সমস্যা নেই চলুন আমি আপনাকে পৌঁছে দেই, যদি আপনার কোনো সমস্যা না থাকে। নিরুপায় স্বর্ণালী ভয়ে অস্থির হয়ে যাচ্ছিল, অপরিচিত একজন মানুষের সাথে যাবে কি যাবেনা বুঝতে পারছিল না।
বান্ধবীদের কথা ভেবেও কান্না পাচ্ছিল এত স্বার্থপর হয় মানুষ? একবারও স্বর্ণালীর কথা ভাবল না ওরা?জুয়েল বুঝতে পেরে বললো, আমাকে বিশ^াস করতে পারেন, আমি খারাপ না। বলে সুন্দর একটি হাসি দিল। হাসিতে কি ছিল স্বর্ণালী জানেনা কিন্তু মন বলছিল যাও ওর সাথে। খুব ভদ্র আচরন করেছে সেদিন জুয়েল। নিরাপদে স্বর্ণালীকে পৌঁছে দিয়ে গেছে ওর হোস্টেলে। স্বর্ণালীর বান্ধবীরা খুবই অনুতপ্ত, সরি বলছে সবাই কিন্তু ওর সেদিকে কোনো খেয়াল নেই।
বিছানার শুয়ে শুধু জুয়েলের কথাই ভাবছে। এই মানুষটা তাকে এত বড় একটা বিপদ থেকে রক্ষা করেছে, তাকে সাহায্য করেছে। কৃতজ্ঞতায় স্বর্ণালীর চোখ জল এসে পড়েছে। চোখ বন্ধ করতেই জুয়েলের মুখটা ভেসে উঠে। কোনোভাবেই জুয়েলের ছবিটা মুছতে পারছিলনা। বড় বেশি ভাল লাগছিল জুয়েলকে। স্বর্ণালী বুঝতে পারল সে জুয়েলকে ভালবেসে ফেলেছে।
সারারাত স্বর্ণালী ঘুমাতে পারেনি,অস্থির লাগছিল। সকাল হতেই ফ্রেশ হয়ে জুয়েলকে ফোন করল স্বর্ণালী একটু দেখা করার জন্য। গতকাল রাতে ফোননাম্বারটা জুয়েল দিয়েছিল। জুয়েল স্বর্ণালীর আগেই চলে এলো একগুচ্ছ দোলনচাপা নিয়ে। কেমন আছেন জিজ্ঞেস করতেই স্বর্ণালী বললো,কাল সারারাত আমি একটুও ঘুমাতে পারিনি,আপনার জন্য অন্যরকম কিছু ফিল করছি। আমি আপনাকে ভালবেসে ফেলেছি। জুয়েল বললো, তাহলে আপনি করে বলছ কেন? আমিও তোমকে ভালবেসে ফেলেছি সেই প্রথম দেখা থেকেই। তোমার মিষ্টি হাসি মুখ আমাকে পাগল করে দিচ্ছিল কিন্তু বলার সাহস হচ্ছিল না। সুন্দর, স্মার্ট,সুঠাম দেহের অধিকারী, রোমান্টিক জুয়েল আজ স্বর্ণালীর স্বামী। ভাবতেই অদ্ভুত এক শিহরণ খেলে যাচ্ছে স্বর্ণালীর ভিতর।
চা খাওয়ার পর স্বর্ণালী যখন কাপ উঠাচ্ছিল জুয়েল স্বর্ণালীকে ইশারা করছিল যেন রুমে আসে। জুয়েলের মা সেটা দেখতে পেয়ে স্বর্ণালীকে বললো, যাও জুয়েলের সাথে একটু ঘুরে এসো। রুমে যাওয়ার দরকার নেই, বাইরে ঘুরতে যাও। স্বর্ণালী লজ্জায় লাল হয়ে যাচ্ছিল আর জুয়েল হা হা করে হাসছিল। স্বর্ণালী হলুদ শাড়ি পড়েছে, সাথে লাল ব্লাউজ, লাল টিপ, হাতে কাচের রেশমি চুড়ি। পরীর মতো লাগছিল তাকে। জুয়েলের মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছিল। নতুন বউকে নিয়ে পুরো বাড়িটা ঘুরে দেখাচ্ছে জুয়েল, আর ভাবছে কখন স্বর্ণালীকে একটু কাছে পাব। বিয়ের রং লাগলে যে মানুষ এত সুন্দর হয়ে উঠে স্বর্ণালীকে দেখে সেটা বুঝতে পারল।
দুপুর গড়িয়ে এল, সবাই গোসল শেষ করে খেতে বসল। জুয়েলের মা স্বর্ণালীকে আদর করে খাইয়ে দিচ্ছিল। জুয়েলের খুব আনন্দ হচ্ছিল। মা স্বর্ণালীকে এতটা ভালবেসেছে বলে, কারণ স্বর্ণালীর বাবা-মা কেউ ছিলনা। স্বর্ণালীর চোখে জল এসে যাচ্ছিল। খাওয়ার পর স্বর্ণালীর শ্বাশুড়ি বললো, যাও তোমরা রুমে যাও, জুয়েল তোমার জন্য সুন্দর করে সাজিয়ে রেখেছে ওই রুম। আমাদের কাউকে ওই রুমে ঢুকতে দেয়নি, আজ তুমি এসেছ তুমি ওই ঘরের লক্ষ্মী।
জুয়েল স্বর্ণালীকে নিয়ে যাচ্ছে তাদরে স্বপ্নের ঘরে। দরজা খুলে ভিতরে ঢুকে স্বর্ণালী অবাক হয়ে গেল। এত সুন্দর, পরিপাটি, গোছানো একটি রুম খুশিতে মন ভরে গেল। একটা ড্রেসিং টেবিল, তার উপরে পারফিউম, নেইলপালিশ, লিপস্টিক, কাচের চুড়ি যা স্বর্ণালীর পছন্দের। সব সাজিয়ে রেখেছে জুয়েল। জানালায় ধবধবে সাদা পর্দা, বিছানাটা একদম গোছানো, দেয়ালে স্বর্ণালী আর জুয়েলের এনগেইজমেন্টের একটি ছবি বাঁধানো, বিছানাটা ফুল দিয়ে সাজানো, ফুলের গন্ধে ভরে আছে রুম।
স্বর্ণালীর এটাই স্বপ্ন ছিল, সে জুয়েলকে বলেছে তার রুমটা এমন হবে। জুয়েল যে তার স্বপ্নটা সত্যিই এমন করে তুলবে, এটা ভাবতে পারেনি স্বর্ণালী। আনন্দে কৃতজ্ঞতায় চোখে পানি এসে গেছে ওর। জুয়েল দরজাটা বন্ধ করে হাসি মুখে দু’হাত বাড়িয়ে দিয়েছে স্বর্ণালীর দিকে। স্বর্ণালী ধীর গতিতে জুয়েলের প্রতি শ্রদ্ধা, ভালবাসা নিয়ে এগিয়ে এসে ধরা দিল। জুয়েল-স্বর্ণালী কে প্রচন্ড আবেগে বুকের মধ্যে জড়িয়ে বলছে ভালবাসি ভালবাসি অনেক বেশি ভালবাসি। স্বর্ণালীও জুয়েলকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলছে, আমিও তোমাকে অনেক বেশি ভালবাসি। তোমাকে ধন্যবাদ তুমি আমার স্বপ্ন পূরণ করেছ, সুন্দর সাজানো-গোছানো একটি রুম দিয়েছ।
জুয়েল আদরে আদরে স্বর্ণালীকে ভরিয়ে দিচ্ছিল। পরে সোফায় বসে জুয়েল স্বর্ণালীকে চুলে বিলি কেটে দিচ্ছিল। স্বর্ণালী গভীর আবেশে জুয়েলের কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে গিয়েছে। ঘুম ভাঙ্গতেই দেখে জুয়েল ওর দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। স্বর্ণালী বললো, কি ব্যাপার তুমি ঘুমাওনি? জুয়েল বললো, তুমি এত সুন্দর করে ঘুমাচ্ছিলে, তোমাকে এত সুন্দর লাগছিল যে আমি চোখের পলক ফেলতে চাইনি। এই সুন্দর্য কি সব সময় দেখা যাবে?সন্ধ্যা হয়ে এলো। জুয়েল বললো, চলো বিছানায় গিয়ে শুই। স্বর্ণালী বললো, এই সন্ধ্যাবেলা কেউ বিছানায় যায়? বলে দৌঁড়ে পালিয়ে গেল। জুয়েল হা হা করে হাসি দিয়ে উঠে গেল।
সবাই চা খেয়ে গল্প করছিল, স্বর্ণালী চায়ের কাপ ধুতে গেল। পিছন থেকে জুয়েল তাকে জড়িয়ে ধরে বলছে, আমার লক্ষ্মী বউটা এত কাজ করছে, দাও আমি সব ধুয়ে দিচ্ছি। দু’জনে সব কাজ শেষ করে সবার সাথে গল্পে যোগ দিল। অনেক রাত পর্যন্ত গল্প করে রাতের খাবার খেয়ে জুয়েলের বাবা-মার বিছানা ঠিক করে দিয়ে স্বর্ণালী তার রুমে গেল।
জুয়েল আগেই রুমে এসে অপেক্ষা করছে স্বর্ণালীর জন্য। স্বর্ণালী রুমে ঢুকতেই রুমের দরজা বন্ধ হয়ে গেল। স্বর্ণালী ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে চুলগুলো আঁচড়ে নিল। জুয়েল পিছন থেকে জড়িয়ে আছে স্বর্ণালীকে। দু’জনের চোখেই খুশির ঝিলিক। আয়নার দিকে তাকিয়ে আছে দু’জনেই। জুয়েল স্বর্ণালীকে বললো, ধন্যবাদ আমার জীবনে আসার জন্য। আমি সব সময় তোমাকে ভালবাসবো, তোমর সব স্বপ্ন পূরণ করব। শুধু তুমি আমার পাশে থেকো, আর আমাকে ভালবেসো।
স্বর্ণালী চোখের জল ধরে রাখতে পাছিল না, এত উপহার দিয়েছে জুয়েল আর ওর পরিবার। কৃতজ্ঞতায় জড়িয়ে ধরেছে জুয়েলকে। জুয়েল স্বর্ণালীকে কোলে তুলে বিছানায় নিয়ে এল। পরম মমতায় জুয়েল স্বর্ণালীকে আগলে ধরে আছে বুকের মধ্যে। স্বর্ণালী ডুকরে-ডুকরে কেঁদে উঠছে, আর ভাবছে সে ভুল করেনি জুয়েলকে ভালবেসে। মানুষ এতটা ভালবাসতে পারে জুয়েলকে না পেলে কখনোই বোঝা যেত না। জুয়েল স্বর্ণালীকে আদরে-সোহাগে ভরিয়ে তুলেছে।
ঘড়ির এলার্ম পরতেই ঘুম ভাঙ্গল স্বর্ণালীর। কোথায় আছে সে? অনেকক্ষণ বুঝতে পারছিলনা। এতক্ষণ যে সে স্বপ্ন দেখছিল সেটা বুঝতে পেরে মনের অজান্তেই হেসে ফেললো। তার মত অনাথ আশ্রমে থাকা মেয়েকে কি কেউ ভালবাসবে?
কাজ শুরু করতে হবে ভেবে স্বর্ণালী বিছানা ছাড়ল। কিন্তু জুয়েলকে কোনোভাবেই মন থেকে সরাতে পারছিলনা স্বর্ণালী ॥
আরবি/ আরপি/ ৪ মে, ২০১৭