ঢাকা ,
বার : সোমবার
তারিখ : ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
বাংলা : ৯ পৌষ ১৪৩১
Dcnewsbd Facebook
Dcnewsbd Twitter

শিরোনাম :

প্রথম পাতা সম্পাদকীয় উপ-সম্পাদকীয় নারী নেতৃত্ব এবং ভবিষ্যত ভাবনা

নারী নেতৃত্ব এবং ভবিষ্যত ভাবনা

0
1967
ছবি : ইন্টারনেট

নারী-পুরুষ উভয়েই ঈশ্বরের সৃষ্ট। সৃষ্টিকর্তা পুরুষের পাশাপাশি পৃথিবীতে নারীর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিলেন বলেই নারীকে তিনি সৃষ্টি করেছিলেন। পবিত্র বাইবেলের ইতিহাসে এবং জগতের ইতিহাসে নারীর অবদানের বিষয়গুলো খুব জোরালোভাবে লেখা না থাকলেও বিভিন্ন সময়ে ও কাজে নারীদের অংশগ্রহণের কথা সব ইতিহাসেই স্পস্টভাবে উল্লেখ আছে। সভ্যতার শুরু থেকেই গোত্রে গোত্রে, সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়ে, দেশে দেশে যুদ্ধ বিগ্রহ, এমনকি একই দেশের অভ্যন্তরে গৃহযুদ্ধ বা দাঙ্গার মতো পরিস্থিতির উদ্ভব হলে নারীরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে এবং হচ্ছে। আবার যুদ্ধ বা সংঘাতময় পরিস্থিতিতে নারীকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব নিতে হয় এবং গৃহাভ্যন্তর থেকে শুরু করে যুদ্ধক্ষেত্র পর্যন্ত সর্বত্র দায়িত্ব পালন করার পরও সে যুদ্ধ বা সংঘাতের দুর্বলতম শিকার হিসেবেই বিবেচিত হয় নারী।

নারীরা সকল সৃষ্টির পিছনে থেকে পুরুষদের অদৃশ্য এক শক্তিতে সাহস যুগিয়েছে এবং তাদেরকে সফল করেছে তা পুরুষরা বিভিন্ন সময় স্বীকার করলেও নারী ও পুরুষের মধ্যে যে বৈষম্যের দেয়াল তা রয়েই গেছে। উন্নত বিশ্বে অনেক আগে থেকেই নারীরা তাদের অধিকার আদায়ে সোচ্চার হয়েছে এবং একটা পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছতে সক্ষম হয়েছে। প্রকৃত পক্ষে নারীদের আন্দোলনের ফলেই সৃষ্টি হয়েছে ৮ই মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস। বিশ্বের প্রতিটি দেশেই এই দিবসটিকে পালন করা হয় যার ফলশ্রুতিতে অনেক দেশেই নারীরা তাদের ন্যায্য অধিকার ও সকল ক্ষেত্রে তাদের প্রবেশগম্যতার বিষয়ে কিছুটা হলেও এগিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে এবং হচ্ছে।

আমাদের দেশেও একশ বছর আগের নারীদের শিক্ষা, সংস্কৃতি, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রের যে চিত্র আমরা বইয়ের পাতায় পড়েছি বা শুনেছি আর তা আর নেই। আমাদের দেশের নারীরা শতভাগ না হলেও কিছুটা হলেও তাদের অধিকার আদায় করতে পেরেছে। এটা সম্ভব হয়েছে বেগম সুফিয়া কামাল, রাশেদা কে. চৌধুরীর মতো অনেক মহীয়সী নারীদের আন্দোলনের কারণে। অনেক ত্যাগ ও আন্দোলনের ফলে নারীরা হয়তো ঘরের চার দেয়ালের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছে কিন্তু যে মর্যাদা বা ক্ষমতা তাদের পাওয়া দরকার সেই জায়গায় আজো পৌঁছাতে পারেনি।

সমাজের নানা শ্রেণিসম্পর্কের মধ্যে সর্বব্যাপ্ত সম্পর্ক হলো নারী ও পুরুষের সম্পর্ক। পরস্পরের অবস্থান ও ভূমিকা নির্ধারণে সমাজের সদস্য হিসেবে নারী ও পুরুষ উভয়ের ওপর সংস্কৃতি বিশেষ প্রভাব বিস্তারের কাজ করে। প্রায় সকল সংস্কৃতিতে নারীরমুক্ত চলাচল নিন্দনীয়, অপরদিকে পুরুষের চার দেয়ালের মধ্যে আবদ্ধ থাকা নিন্দনীয়। নারীকে সমাজে যে অবস্থানে রাখা হয় তা সবসময়ই পুরুষের অবস্থানের চেয়ে নিচে। সমাজের সম্পদ ও সুবিধা প্রাপ্তির ক্ষেত্রেও পুরুষের তূলনায় অব্যাহতভাবে নারীর গম্যতা এবং নিয়ন্ত্রণ এখনো অনেক কম।

ক্ষমতায়ন উন্নয়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান, একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া যা দ্বারা মানুষ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে, বাধাবিপত্তি ও প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করতে, সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অংশগ্রহণে এবং ব্যক্তিগত ও সামাজিক উভয় পরিকল্পনার ক্ষেত্রে সক্ষমতা ও সুযোগ অর্জন করে। এরজন্য দরকার নারীদের আত্মসম্মান এবং আত্মবিশ্বাস। নারীর ক্ষমতায়ন তখনই হবে যখন নারীরা সকল ক্ষেত্রে সিদ্ধান্তগ্রহণ ও বাস্তবায়নে সমর্থ হবে।

নারী ক্ষমতায়নের লক্ষ্য হচ্ছে নারী তার স্বাধীন মতামত প্রকাশের অধিকার পাবে। নারী সর্বক্ষেত্রে তার বুদ্ধিমত্তা ও অভিজ্ঞতা দিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে পারবে।

মানুষ হিসেবে নারী সমাজে নিরাপত্তা পাবে। সকল সম্পদে নারীর অংশীদারিত্ব থাকবে। নারী শুধু ভোগের বস্তু হিসেবে নয়, তার পরিবার, সমাজ ও দেশের একটা মূল্যবান সম্পদ হিসেবে পরিগণিত হবে। নারীতার মেধা ও মনন দিয়ে সমাজ ও দেশের সার্বিক উন্নয়নে সক্রিয় অংশগ্রহণ করবে।

বাংলাদেশে খ্রীষ্টান সম্প্রদায় জনসংখ্যাগত দিক দিয়ে খুবই নগণ্য হলেও এই সম্প্রদায়ের নারীরা অন্যান্যদের তুলনায় বেশ এগিয়ে। সংখ্যার নগণ্যতার কারণেই হয়তো তারা দেশের বড় বড় পর্যায়ে তেমনভাবে প্রতিষ্ঠিত নয় কিন্তু স্কুলসমূহে শিক্ষকতা, বিভিন্ন বেসরকারী সংস্থা ও সেবা প্রতিষ্ঠানগুলোতে নেতৃত্ব দেয়া চোখে পড়ার মতো। পারিবারিকভাবে খ্রিস্টান মেয়েদের চাকুরীর ক্ষেত্রে বাধা দেয়া হয় না বললেই চলে। তবে সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিভিন্ন পদে তাদের অবস্থান থাকলেও সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে এখনো তারা পিছিয়ে রয়েছে। অর্থাৎ ক্ষমতায়নের দিক থেকে তারা এখনো লক্ষ্যমাত্রা ছুঁতে পারেনি। এর জন্য নারীদের মান্ডলিক ও সামাজিক কাজে আগ্রহ নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে, আরো সময় দিয়ে বড় বড় পদগুলোতেও যে তারা কাজ করতে পারে সেক্ষেত্রে নিজেদের যোগ্যতার পরিচয় তুলে ধরতে হবে।

মূলত: পরিবার, কর্মক্ষেত্র এবং সমাজে নারীর পরিসর বাড়ানো প্রয়োজন। পরিবার, কর্মক্ষেত্র এবং সমাজে নারীরা যে সকল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে:

পারিবারিক ক্ষেত্রে পালনীয় ভূমিকা: নিজ স্বার্থকে বড় করে না দেখে পরিবারের সকলের মঙ্গলে কাজ করা, সন্তানদের সঠিক গঠনে সময় ও গুরুত্ব দেয়া, ধৈর্য ও সহ্য শক্তি বাড়ানোর উপায় খুঁজে বের করা, পরিবারে কেউ ভুল করলে সেটা নিয়ে সমালোচনা না করে তার ভুল ধরিয়ে দেয়া ও সঠিক পথটি দেখিয়ে দেয়া, একতাই শক্তি বা বল এই সত্যকে মনে রেখে ভাইবোন সকলে একত্রে থাকার চেষ্টা অব্যাহত রাখা, পরিবারের ছোট সদস্যদের মধ্যে আধ্যাত্মিকতা/ধর্মীয় চেতনায় বলবান হতে সহায়তা করা, নিজে এবং পরিবারের প্রত্যেকটি লেখাপড়া জানা সদস্যকে বাইবেল পাঠে উদ্বুদ্ধ করা, প্রার্থনার শক্তি বিষয়ে বিশ্বাস বৃদ্ধি করা, প্রার্থনাশীল জীবনযাপনে সকলকে অনুপ্রাণিত করা, চার্চের সকল কর্মকান্ডে নিজে এবং অন্য সদস্যদের সংযুক্ত রাখা, অনুপ্রাণিত করা, ধনী-গরীব ভেদাভেদ না করে সকল আত্মীয় স্বজনদের একই বন্ধনে আবদ্ধ রাখার চেষ্টা করা প্রভৃতি।

কর্মক্ষেত্রে পালনীয় ভূমিকা: যদি একই সম্প্রদায়ের বা কমিউনিটির হই তাহলে নিজেদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ আরো শক্তিশালী করা, অন্য কমিউনিটির হলে নিজের আচারআচরণ দিয়ে তাদের মাঝে খ্রিস্টের আদর্শ তুলে ধরা, নিজের বিশ্বাস, সততা ও নেতার অন্যান্য গুণাবলী যদি থাকে তাতে অটল থাকা, মিথ্যা বা প্রতারণার আশ্রয় না নেয়া, অর্থলিপ্সা থাকলে তা সংবরণ করা, অন্যদের পিছনে সমালোচনা না করে সামনা-সামনি গঠনমূলক আলোচনার মাধ্যমে কাজের ক্ষেত্রে উন্নতি করতে সহায়তা করা, অন্যের বিপদে পাশে দাঁড়ানো।

সামাজিক ক্ষেত্রে পালনীয় ভূমিকা: সমাজের জন্য যা মঙ্গলজনক তা নিয়ে নিজে চিন্তা করা ও অন্যদের সাথে সহভাগিতা করা। সকলকে সাথে নিয়ে, তাদের মতামতের প্রেক্ষিতে কার্যক্রম হাতে নেয়া ও বাস্তবায়ন করা।নিয়মিত সকলের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করা। সব সময় সকলের পাশে থাকার মানসিকতা থাকা। সকলকে সৎপরামর্শ দেয়া, কোন্দল না বাধিয়ে তা মেটানোর চেষ্টা করা, সকলকে একত্রে এক বন্ধনে রাখার চেষ্টা করা, বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা নিজের জন্য শুধু নয় কিন্তু সকলের জন্য আদায় করা প্রভৃতি।

যে সকল নারীর ভিতরে নেতৃত্বের উল্লিখিত গুণাবলী থাকবে তিনি সকলের দ্বারা সমাদৃত হবেন এবং ধীরে ধীরে সমাজের নেতৃত্ব দানের স্থানে পৌঁছাতে পারবেন। আমরা বিশ্বাস করি সেদিন হয়তো আর বেশি দেরি নয় যখন নারী পুরুষ একত্রে বাংলাদেশের খ্রিস্টমন্ডলীর এবং দেশের খুব গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রমের বাস্তবায়নে উভয়ের মতামতের প্রেক্ষিতে সিদ্ধান্তগ্রহণ ও বাস্তবায়ন করবে। সেই সুদিনের আশায় আমরা আছি এবং থাকবো ॥

লেখক:
আঞ্চলিক পরিচালক, কারিতাস খুলনা অঞ্চল
লেখক ও প্রাবন্ধিক

আরবি/আরপি/১১ মে, ২০১৭