ঢাকা ,
বার : সোমবার
তারিখ : ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
বাংলা : ৯ পৌষ ১৪৩১
Dcnewsbd Facebook
Dcnewsbd Twitter

শিরোনাম :

প্রথম পাতা ফিচার একজন মায়ের জীবনের পিছনের গল্প

একজন মায়ের জীবনের পিছনের গল্প

0
1789

পৃথিবীর সবচেয়ে মধুর শব্দ ‘মা’। ছোট একটি শব্দ হলেও এর বিশালতা অনেক।

সন্তান যখন পৃথিবীতে আসে, তখন সৃষ্টিকর্তা সেই সন্তানকে একটি উপহার দেন। যেই উপহারের সাথে অন্য কোনো উপহারের তুলনা চলে না। আর সেই উপহারটি হল “মা”। পৃথিবীতে প্রতিটি মা একজন সৈনিক। তাদের যুদ্ধের কথা বা তাদের সফলতার কথা, তাদের মধ্যেকার কথা আমরা খুব কমই জানি। সমাজ বাস্তবতায় এমন মাও রয়েছেন, যে মা শুধুই মা নয়, হয়েছেন একাধারে মমতাময়ী, একাকী জীবন যোদ্ধা, পরিহাসের শিকার আরো অনেক কিছু।  তেমনি একজন মা হলেন সিলভি গমেজ। যিনি একেধারে একজন মা, একজন বাবা আবার একজন বন্ধু।

সোনার চামচ মুখে নিয়েই জন্ম নিয়েছিলেন সিলভি গমেজ। পরিবারের একমাত্র মেয়ে হওয়ায় আদরের কমতি ছিল না। চাওয়ার আগেই সবকিছু পেতেন তিনি। কিন্তু জীবনের অবসাদটা নেমে আসে বিয়ের পরই।

শ্বশুর বাড়িতে এসে দেখেন খাবারের জন্য কয়েকটি প্লেট আর কিছু জিনিস ছাড়া কিছুই নেই। ভালবেসে হিন্দু পরিবারে বিয়ে করায় ত্যাজ্য করা হয় সিলভিকে। তাই আর ফিরে যাওয়ারও অবকাশ ছিল না বাবার বাড়িতে। মেনে নিলেন বাস্তবতা আর অভাবকে। বিয়ের প্রথম বছরই তার কোল জুড়ে আসে একটি মেয়ে। কিন্তু ভূমিষ্ঠ হওয়ার সময় মাথায় আঘাত পায় মেয়েটি, আর ৪ দিনের মাথায় মেয়েটি মারা যায়।

স্বামী পরিবার চালানোর মতো যথেষ্ট অর্থ দিত না। এই অভাবে চালের গুড়া খাইয়ে মেয়েকে বড় করতে থাকেন। এর ৩ বছর পর আরেকটি মেয়ে আসে কোল জুড়ে। এভাবে কয়েক বছর পর আরেকটি মেয়ে সন্তান জন্ম নেয়। অভাবের সংসাদের তিন মেয়ে যেন হয়ে উঠলো কঠিন একটি বাস্তবতা।

03৩ মেয়ে নিয়ে অভাবের মধ্যে কূল পায় না সিলভি। পেটের তাগিদে বাসা বাড়িতে দুই হাজার টাকার বিনিময়ে কাজের বুয়া হিসেবে কাজ শুরু করেন। বড় মেয়েকে হোস্টেলে দিয়ে, ছোট ২ মেয়েকে নিয়ে তার কষ্টের দিনগুলো পার হতে থাকে। চলতে থাকে জীবনে বেঁচে থাকার সংগ্রাম।

কিছুদিন পর তিনি গার্মেন্টসে ২৬ শ টাকার বেতনে চাকুরী নেন। সেখানে শাড়ি পড়ে যাওয়ার নিয়ম ছিল না।নতুন জামা কেনারও সামর্থ নেই, তাই শাড়ি কেটে সালোয়ার কামিজ বানিয়ে সেটি পরেই কাজে যেত।

বাংলাদেশের বস্ত্র শিল্পের সবচেয়ে বেশি চাহিদা থাকলেও, এই সেক্টরের পরিবেশ এবং শ্রমিকদের অবস্থা বা পরিবেশ চিরকালই খারাপ। গার্মেন্টসের মতো অস্বস্তিকর পরিবেশে তাকে পড়তে হলো জীবনের দায়ে। বসদের বাজে কথা ও ব্যাবহার সিলভি মুখ বুঝেই সহ্য করে মেয়েদের মুখের দিকে তাকিয়ে।

জীবনের অস্থিত্বের দায়ে ওভার টাইম কাজ করেছেন। এমনও দিন গেছে সকাল, দুপুর, রাত সারাদিনই  কাজ করেছে। সামান্য সময়টুকু পায়নি বাসায় আসার। এমনকি ভাতও মেলেনি এক বেলায়ও। এক পিস পাউরুটি আর একটা কলা খেয়েই দিন পার করতে হয়েছে। ওভার টাইমের টাকা দিয়ে ছোট মেয়েকে দুধ কিনে খাওয়াতে হতো।

এর কয়েক বছর পর সিলভি একটি মার্কেটিং কোম্পানিতে ৭ হাজার টাকায় চাকুরী নেয়। শুরু হয় তার দিন বদল। এখানেও তিনি ওভার টাইম কাজ করে ১২ হাজার টাকা পর্যন্ত আয় করে।

এর পাশাপাশি পূর্বের গার্মেন্টসের সহকর্মী সাহানাজকে সাথে নিয়ে ছোট একটি ব্যাবসা শুরু করে সিলভি। যৌথভাবে বেসরকারি ব্যাংকে একাউন্ট করে ৩০ হাজার টাকা জমা করে তারা। পরবর্তীতে এই ৩০ হাজার টাকা একটি ধানের জমিতে বিনিয়োগ করে এবং বছর শেষে ৩০ মণ ধান মূলধনসহ ফেরৎ পেত।

পাল্টে যায় সিলভির দিন।  তাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। বড় মেয়ে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় পাস করার পর একটি সম্ভ্রান্ত পরিবারে বিয়ে দেয়। মেঝো মেয়ে এবার উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা লিখছে আর ছোট মেয়ে ৭ম শ্রেণিতে পড়ে।

মুখ থুবরে পড়ে থাকা সিলভির দিনগুলো আবার সোজা সরল হয়ে উঠে এভাবে। এভাবেই সিলভি পরাজিত করেছে একাকীত্বকে, দারিদ্রতাকে সাথে একাকার হয়ে থাকা নির্মম বাস্তবতাকে।

মানুষ থেমে থাকে না, সিলভিও থেমে থাকেনি। এখনো নিরবে ভাবে সেই ফেলে আসা যন্ত্রণার স্মৃতিগুলো, চোখের কোণে জলে ভরে ওঠে। ডিসিনিউজের সাথে আলাপকালে বার বার তার চোখের কোণে বেদনার অশ্রুগুলো চিকচিক করে উঠছিলো।

সিলভি মেয়েদের নিজের স্মৃতি হাতরে বলে, “আমি জানি আমি তোদের চাহিদা সব পূরণ করতে ব্যর্থ হয়েছি। কিন্তু তোরা যখন আমার কাছে কিছু আবদার করতি, আমি সেই আবদারগুলো একটি কাগজে লিখে রাখতাম, মাস শেষে বেতন পেয়ে সেই কাগজটা পরতাম, আর তোরা যা যা খেতে চাইতিস, বা পরতে চাইতিস, সেগুলো কিনে আনতাম।

মেয়ে সবর্ণাকে সিলভি বলে, ‘জানিস, আমি আজও তোর পরা সালোয়ার কামিজগুলো পরি। নিজের জন্য কিচ্ছু না, যা করেছিলাম সব তোদের জন্যই। কারণ সবার তো বাবা মা থাকে, কিন্তু তোদের বাবা থেকেও নেই। আমি তোদের বাবা-মা দুটোই ছিলাম। আমি এটা বিশ্বাস করতাম, যে নৌকাতে মাঝি নেই, পাল নেই, সেই নৌকার হাল নিজেকেই শক্তভাবে ধরতে হয়। আমি আজও সেই হাল ধরে আছি, ধরে থাকবো। কারণ তোদেরকে পার করাটাই যে আমার শেষ কাজ।’

আরবি/আরপি/১৫ মে, ২০১৭