ঢাকা ,
বার : সোমবার
তারিখ : ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
বাংলা : ৯ পৌষ ১৪৩১
Dcnewsbd Facebook
Dcnewsbd Twitter

শিরোনাম :

নীল চিঠি

0
2163

চিঠিটা পাই সন্ধ্যাবেলা। বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিচ্ছিলাম। দারোয়ান এসে চিঠিটা দিয়ে গেল।

কে দিয়েছে জিজ্ঞেস করতেই জানালো, বাহিরের বারান্দায় চিঠিটা পড়েছিলো।

দেখে বুঝলাম, বেশ পুরনো চিঠি। ভালো করে লক্ষ্য করতেই দেখলাম আমার নাম লেখা। হাতের লেখা অস্পষ্ট হয়ে এসেছে প্রায়। প্রেরকের ঠিকানা কিছুই বোঝা যায় না।

হাতের লেখা দেখে মুহুর্তেই অনেক কিছুই হাইপোথিসিস করে ফেললাম। মেয়েলি হাতের লেখা। বেশ উচ্চশিক্ষিত এবং ধনী পরিবারের অবশ্যই। চিঠির দামি খাম তারই ইঙ্গিত দিচ্ছে। মেয়েটির রুচিবোধ আছে। ঠিকানা লেখার ধরন এবং ভাষাপ্রয়োগ তাই বলে।

বন্ধুদের সাথে আড্ডা শেষ হতে সেদিন বেশ রাত হয়েছিলো। চিঠিটার কথা বেমালুম ভুলেই গিয়েছিলাম। কোথায় যে রেখেছি তাও মনে ছিল না।

বেশ কয়েকদিন পর। সেদিন রাত্রে দেরিতে বিছানায় গিয়েছি। একটি লেখা জমা দেবার তাড়া ছিল। লেখাটি শেষ করে বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই রাজ্যের ঘুম দু-চোখে এসে জড়ো হয়।

হঠাৎ শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। ঘর অন্ধকার। স্পষ্ট বুঝতে পারলাম কেউ যেন ঘরে চলাফেরা করছে। হাতের চুড়ির স্পষ্ট রিমঝিম আওয়াজ শুনতে পেলাম। গোলাপের পাপড়ির গন্ধ সারা ঘরময় ছড়িয়ে আছে। গোলাপের গন্ধের সাথে আমার পরিচয় আছে। তবে এ রকম মায়াময় গন্ধ আগে কখনো পাইনি। ভয় পেয়ে গেলাম। হাত বাড়িয়ে টেবিল ল্যাম্প যে জ্বালাবো সেই সাহস পাচ্ছি না। গলা শুকিয়ে যাবার অবস্থা। ততক্ষণে ঘরের অন্ধকার সহনীয় হয়ে এসেছে। হালকা আলো-আঁধার ঘরের মধ্যে। হালকা আলোয় দেখলাম শাড়ী পরিহিত নারীমূর্তি ঘরের মধ্যে ঘোরাফেরা করছে।

কোনোভাবেই বুঝতে পারছি না নারীমূর্তি ঘরের মধ্যে প্রবেশ করল কীভাবে! বিছানায় আসার আগে দরজা তো ভালভাবেই বন্ধ করেছি। দরজার দিকে তাকালাম। দরজা ঠিকই বন্ধ আছে।

ততক্ষণে আমার সাহস বেড়ে গিয়েছে। বিছানায় চুপচাপ বসে আছি। দেখি মূর্তিটি কী করে। ধীরে ধীরে মূর্তিটি আমার লেখার টেবিলের কাছে এগিয়ে এলো। কী যেন খুঁজছে ওই মানবী।

চোর সন্দেহ করে চিৎকার দিবো ভাবছি। কিন্তু কৌতুহলবশত চিৎকার দেওয়া থেকে বিরত থাকলাম।
দেখলাম নারীমূর্তিটি একটি খাম হাতে নিয়ে উল্টে-পাল্টে দেখছে। ভালভাবে লক্ষ্য করে দেখি, সেদিন আড্ডার সময় দারোয়ানের দেওয়া সেই চিঠিটা।

নারীটি আলতো করে চিঠির একপাশ ছিঁড়ে ফেললো। খাম ছেঁড়ার শব্দ এখনো আমার কানে বাজে। যক্ষের ধন চুরি যাবে ভেবে এবার চিৎকার করে উঠলাম। অন্ধকারে হারিয়ে গেল নারীমূর্তিটি।

আমার চিৎকারে আমারই ঘুম ভেঙে গেল। শরীর ঘামে ভিজে যাচ্ছে। মনে হলো এতক্ষণ সব যেন বাস্তবে দেখেছি।
ঘরের লাইট জ্বালালাম। লেখার টেবিলে তাকিয়ে দেখি খামটি পড়ে আছে। একপাশ ছেঁড়া। তাহলে এতক্ষণ যা দেখেছি তা স্বপ্ন নয়! বাস্তবেই ঘটেছে। কিন্তু বাস্তব হওয়ার সম্ভাবনা কীভাবে। এইমাত্র তো আমি ঘুম থেকে জেগে উঠেছি।

ফ্রিজ থেকে ঠা-া জল বের করে ঢক্ঢক্ করে খেয়ে নিলাম।

লেখার টেবিলে গিয়ে বসলাম। খাম থেকে চিঠিটা বের করি। নীল কাগজে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা। পড়তে শুরু করলাম।

প্রিয়তমেষু,
পৃথিবীর ইতিহাস যদি উল্টো দিকে বইতে শুরু করে তবুও আমার ভালবাসা তোমার দিকেই বয়ে যাবে। দক্ষিণা পবন সুভাষিত আবেগে যেমন দিক-দিগন্ত উথাল-পাথাল করে মনুষ্য মাঝে ভালো লাগার আবেশ তৈরি করে, তেমনি আমার ভালবাসা তোমার আমার মাঝে যে অদৃশ্য সামাজিক দেয়াল দাঁড়িয়ে আছে- তা ভেদ করে তোমার কাছে পৌঁছবে। ভাবতে পার, আমি আবার আবহাওয়াবিদ হয়ে গেলাম নাকি; কিন্তু প্রেমের টানে পৃথিবীর যে কেউ অসাধ্য সাধন করতে পারে তা তোমার অবিদিত নয়।

তোমার সাথে আমার প্রথম যে রাত্রে সাক্ষাৎ হয়, সে রাত্রি অমানিশা পূর্ণ ছিল না। ধূপালোকরশ্মি ও তার ¯িœগ্ধ গন্ধ সারা ঘরময় ছড়িয়ে পড়ছিলো। তখনই বুঝেছিলাম তুমি শুধু আমারই। সে রাত্রে পূর্ণ চন্দ্রতারকারাশি যেমন প্রকৃতির মাঝে তার পরিপূর্ণ ভালবাসা উজাড় করে দিয়েছিলো; আমিও তোমাকে প্রথম পুরুষ হিসাবে আমার হৃদয় মাঝারে ঠাঁই দিয়েছিলাম। আজ যখন ভাবি; কষ্টে আমার প্রাণস্পন্দন বন্ধ হয়ে আসতে চায়। কী সময়ই না ইতিহাসের পাতায় পাতায় রচিত হয়েছে।

আমার ভুলটা ছিল তোমাকে আমি বড় বেশি ভালবেসে ফেলেছিলাম। কখনো ঘুর্ণাক্ষরেও ভাবতে পারিনি যে, তোমার আমার মাঝে যোজন যোজন ফারাক। তবু যে প্রতিশ্রুতি তুমি আমায় দিয়েছিলে, তারই বসতি আমার আঙ্গিনায় স্থাপন করেছিলাম। কিন্তু আমার এই আবেগ-অনুভূতিকে কখনো মিথ্যা বলে মনে হয়নি। সে কথা তুমি নিশ্চয়ই জানতে। সমস্ত বাধাকে তুচ্ছ করে তোমাতেই আমার জীবন সঁপেছিলাম। রাঁধা-কৃষ্ণের অবৈধ প্রেমালাপন গীতিকাব্য হয়ে যেমন সাহিত্যের পরতে পরতে লুকিয়ে আছে, তেমনি তোমার আমার এই বাঁধনহারা ছুটে চলা শুধু চলতেই থাকবে আমার মৃত্যুর পরেও। এই নীল কাগজে লেখা চিঠিটার গোপন দুঃখগুলো যখন পড়বে, ততক্ষণ আমি চিরজীবনের জন্য অদৃশালোকে মিশে যাব।

তোমাদের আত্মীয়-স্বজনেরা আমার পরিচয় পেয়ে নিশ্চয়ই ঘৃণার পংক্তিমালা বর্ষণ করেছিলো। নয়তো কেন আর তুমি ফিরে এলে না। সে যা-ই হোক। আমি পতিতাবৃত্তির সাথে জড়িত ছিলাম সত্য; কিন্তু তার চেয়েও বড় সত্য আমি একজন নারী। আমার মধ্যেও মন নামক চেতনাটি বাস করে। আমার মধ্যেও ভালবাসার সপ্তসোপান প্রতিদিন রচিত হয়। পুরুষের হৃদয় থেকে উৎসারিত সত্য আদর-সোহাগ পাবার কামনা আমারও জাগরিত হয়।

কষ্টের সাথে আমার কোনোদিন পরিচয় ছিল না। প্রথম জীবনেও নয়; পরের জীবনেও নয়। তবে আমাকে আঘাত দেবার মনোবাসনায় তোমার লেখা চিঠি পেয়ে সত্যি কষ্ট পেয়েছিলাম। মনে হয়েছিলো কবির কবিতায় কোথাও ছন্দপতন হয়েছে।

আমি আর মৃত্যু যন্ত্রণা সহ্য করতে পারছি না। দেখতে পাচ্ছি মৃত্যুদেবতা আমার সামনে ঘোরাফেরা করছে। স্বর্গ-নরকের আশা কখনো করিনি। তবে এখন জীবনস্বামীর স্মরণাপন্ন হতে ইচ্ছা করছে। দেখা পাবো কিনা জানি না, তবে তাঁর প্রতি একটা প্রশ্ন করতাম- কেন তোমাকে পাইনি। আর অনুরোধ করতাম, তোমায় যেন ভাল রাখেন।

পৃথিবীর সমস্ত কোলাহল থেমে যাচ্ছে। আমার হাত আর চলছে না। বাহিরের দরজায় কে যেন জোরে ধাক্কা মারছে।
ভয় হচ্ছে যদি বেঁচে যাই। লজ্জার একশেষ থাকবে না। জানি বাঁচবো না। যে বিষপান করেছি তার চেয়েও যে বিষের জ্বালা বেঁচে থাকতে পেয়েছি তার প্রতিক্রিয়া আরো বেশি তীব্রতর।

নীল কাগজে চিঠিটা লেখা শেষ করে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত আবার আবছা চোখে পড়লাম। অনুভব করলাম, চিঠির কাগজের নীলের চেয়েও আমার মুখ বিষের জ্বালায় বেশি নীল হয়ে পড়ছে।

তুমি ভালো থেকো।

হতভাগিনী,
নন্দিনী
২৮শে শ্রাবণ ১৩২৪

চিঠিটা পড়া শেষ করলাম। এক শ বছর আগের চিঠি আমার হাতে।
চেয়ার ছেড়ে উঠতে যাব তখনই বুঝতে পারলাম কে যেন জানালার পাশ থেকে সরে গেল। সামনে এগিয়ে যেতেই শুনতে পেলাম হাতের রিমঝিম চুড়ির শব্দ। গোলাপের সেই গন্ধ নাকে এসে লাগলো। টেবিলে ফিরে এসে দেখি, খোলা নীল চিঠিটা নেই।

(লেখক : সাগর কোড়াইয়া# সাহিত্যিক)

 

আরবি/আরপি/১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮