ঢাকা ,
বার : সোমবার
তারিখ : ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
বাংলা : ৯ পৌষ ১৪৩১
Dcnewsbd Facebook
Dcnewsbd Twitter

শিরোনাম :

প্রথম পাতা সম্পাদকীয় উপ-সম্পাদকীয় ছাত্রবস্থায়ই নাগরিক জীবনের শিক্ষা : ক্লাসে একদিন

ছাত্রবস্থায়ই নাগরিক জীবনের শিক্ষা : ক্লাসে একদিন

0
926

আমার চায়না দেশে আসা প্রায় সাত মাস চলছে। সেই সাথে চাইনিজ ভাষা শিখার সময়কালও প্রায় সাত মাস।

লেখক হিলারিউস মুরমু

আমি যে স্কলারশিপের মাধ্যমে এসেছি তার প্রথম শর্তই হলো এক বছর চাইনীজ ভাষা শিখতে হবে। এই সাত মাস ভাষা শিখার পর মনে হলো চাইনিজ ভাষাটি পৃথিবীর সব থেকে কঠিন ভাষা। কারণটা হলো চাইনিজ ভাষার যে স্বরবর্ণ এবং ব্যঞ্জনবর্ণ তারা গবেষণা করে বের করেছে তা অন্যান্য ভাষার চেয়ে ভিন্ন। বাংলা ভাষার কথায় যদি বলি, তাহলে আমাদের বর্ণগুলোকে পাশাপাশি সাজিয়ে লিখলে যেমন একটি শব্দ গঠন হয়। চাইনিজ ভাষায় সেইভাবে গঠন করা যায় না। কারণ তাদের ভাষার প্রত্যেকটি শব্দের জন্য প্রতিকী চিহ্ন ব্যবহার করা হয়। প্রত্যেক প্রতিকী চিহ্নের আবার ভিন্ন স্বর রয়েছে।

অন্যদিকে একই প্রতিকী চিহ্নের অনেক অর্থ রয়েছে। যার ফলে কোন প্রতিকী চিহ্ন কোথায় ব্যবহার হবে এবং হবে না এটা বিদেশিদের জন্য খুবই কঠিন হয়ে যায়। তাই চাইনিজ ভাষা আয়ত্ব করতে হলে শব্দ ভান্ডার যে বেশি বৃদ্ধি করতে পারবে সেই কেবল ভাষা আয়ত্ব করতে পারবে। তবে শব্দভান্ডার বৃদ্ধি করলে সে ব্যক্তি হয়তোবা কথা বলার জন্য খুবই পারদর্শী হবে কিন্তু লেখার দিকে হবে না।

যাইহোক আজকে যে অভিজ্ঞতা সহভাগিতা করতে চাই সেই বিষয়ে আসি। চায়না’র শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালত, এমনকি রাস্তাঘাট থেকে শুরু করে প্রত্যেকটি জায়গায় আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে। ক্লাস রুমগুলোতে প্রজেক্টর ও সাউন্ড সিস্টেমের ব্যবস্থা রয়েছে। সেই সাথে ৩৬ ইঞ্চির টেলিভিশন এবং সিসি ক্যামেরা লাগানো আছে। ক্লাস চলাকালীন শিক্ষার্থীরা এবং শিক্ষকরা কী করছে তা রেকর্ড করা হয়। ক্লাস রুমে টেলিভিশন দেওয়ার অর্থ হলো জাতীয় কোনো ঘটনা, জরুরি ঘোষণা বা বিপদ সংকেতমূলক প্রচার-প্রচারণা টেলিভিশনের মাধ্যমে প্রচার করা হয় এবং ঐ মুহূর্তে কি করতে হবে এবং কি করা উচিৎ এবং উচিৎ নয় তাও টেলিভিশন পর্দায় এবং ক্লাসরুমগুলোতে সাউন্ড সিস্টেমের মাধ্যমে ঘোষণা দেওয়া হয়।

আরেকটা বিষয় আমি আপনাদের জানাতে চাই। সেটা হলো, আমাদের পুরো বিশ্ববিদ্যালয়ের অলিতে গলিতে, খেলার মাঠ থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যান্টিন, হোস্টেলের ছাঁদে এবং ক্লাস রুমের ছাঁদের উপর সাউন্ড সিস্টেম, সিসি ক্যামেরা এবং ওয়াইফাই এর ব্যবস্থা করা আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবন থেকে জরুরি কোনো ঘোষণা যদি আসে তাহলে তা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের সর্বত্রই একযোগে সেই সাউন্ড বক্সের মাধ্যমে ঘোষণা দেওয়া হয়। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকসহ, ছাত্র-ছাত্রী, কর্মচারী এমনকি বাইরে থেকে আগত পথচারী পর্যন্ত জানতে পারে প্রশাসন কি ঘোষণা দিচ্ছে। আরেকট মজার বিষয় হলো, বিকেল ঠিক চারটা থেকে পাঁচটার দিকে সুন্দর সুন্দর গান বাজানো হয়। এতে পুরো বিশ্ববিদ্যালয় খুব ফুরে ফুরে পরিবেশের সৃষ্টি হয়।

যাইহোক এখন মূল বিষয়ে আসি। তার পূর্বে চায়না’র এক সময়ের সব থেকে ভয়াবহ ভূমিকম্পের বিষয়ে জানাই। আমি যদি ভুল না করি তাহলে, ২০১০ সালের মার্চ মাসে প্রথম সপ্তাহ অর্থ্যাৎ ৬ মার্চ-এর দিকে ভয়াবহ ভূমিকম্প হয়েছিল। ভূমিকম্পটি চায়নার রাজধানী বেইজীং-এর আশেপাশে হয়েছিল। ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৮ডিগ্রি। সেই সময় অনেক বড় বড় অট্টালিকা ধ্বসে পরেছিল এবং লক্ষাধিকেরও বেশি মানুষ মারা গিয়েছিল।

একদিন বিকেল চারটার ক্লাসের সময় হঠাৎ দেখি ক্লাস রুমের টেলিভিশন পর্দায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভূমিকম্পের সেই সংবাদ প্রচার হচ্ছে। আমরা মনে করলাম শিক্ষকই মনে হয় ক্লাসে কোনো বিষয় বোঝানোর জন্য তা টেলিভিশন পর্দায় দেখাচ্ছেন। আমরা চুপ করেই ক্লাস করছি। তারপর শিক্ষক নিজেরই যখন টেলিভিশনের দিকে চোখ পড়ল তখন আশ্চর্য হয়ে আমাদের জিজ্ঞেস করল এটা কিভাবে প্রচার হচ্ছে? কেউ কি কোনো সুঁইচ অন করল কিনা? তখন আমরা বললাম না। কিছুক্ষণ পর শুনতে পেলাম অন্যান্য ক্লাস রুমের শিক্ষার্থীরা দৌঁড় দিয়ে নিচে নামছে। আমরা খুব ভয় পেলাম। আমরা মনে করলাম নিশ্চয় ভূমিকম্প হয়েছে বা হচ্ছে। আমরাও দৌঁড় দিয়ে নিচে নামতে শুরু করলাম। আমিও কারও কথা চিন্তা না করে সবার সাথে দৌঁড় দিয়ে ক্লাস রুম থেকে বের হয়ে তিনতলার বারান্দায় নিচের দিকে তাঁকাতে লাগলাম। সেই সময় চাইনিজ শিক্ষার্থীরা সিঁড়ি দিয়ে সবাই দৌঁড়ে নামতে শুরু করেছে। নিচে অনেক পুলিশ। প্রত্যেকটি তলায় পুলিশ। আমরা সবাই খুব ভয় পেলাম। পুলিশদের দেখে ভয়ের মাত্রাটা আরও বেড়ে গেল। তখন আমিও চাইনীজ শিক্ষার্থীদের সাথে নিচে নামার জন্য দৌঁড় দিতে চাইলাম কিন্তু দৌঁড় দেবার সময় পুলিশ আমাকে আটকালো। সে বলল, তোমাকে যেতে হবে না। আমি আশ্চর্য হলাম। আমার পাশে আমাদের ক্লাস শিক্ষক ছিলেন। সেইও দেখল আমাদের সবাইকে যেতে দিচ্ছে না। তখন পুলিশকে শিক্ষক জিজ্ঞেস করলেন কি হচ্ছে?

তখন পুলিশ শিক্ষককে বললেন, এটা ভূমিকম্পপূর্বক অনুশীলন চলছে। ভূমিকম্পের সময় কি করতে হবে, কতটুকু নিজেকে সংযমে রাখতে হবে, কি করা উচিৎ নয়, তার অনুশীলন চলছে। শিক্ষক তখন পুলিশকে জিজ্ঞেস করলেন, এদের তাহলে কি করতে হবে? তখন পুলিশ বলল, বিদেশিদের জন্য কিছুই করতে হবে না। তারপর আমরা আবার ক্লাস রুমে চলে আসলাম।

ক্লাসে আসার পর একটু চিন্তা করলাম। দেশের জাতীয় বিষয়গুলোকে কত গুরুত্বের সাথে দেশের নাগরিকদের জীবনের উন্নতি, সচেতনতা, বাস্তব জীবনে অনুশীলন এবং শিক্ষা হিসেবে প্রচার-প্রচারণা চালানো হয় এখানে। এইভাবে যদি তাদের পাঠ্যপুস্তকের পাশাপাশি ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোকে আমলে নিয়ে দৈনন্দিন জীবনের শিক্ষা হিসেবে অনুশীলন করানো হয়, তাহলে ছোট ছোট বিষয়গুলোর প্রতি সাধারণ নাগরিকদের সচেতনতা আরও বৃদ্ধি পায়। কারণ নাগরিকদের সচেতনতা শিক্ষা জীবন থেকে অনুশীলন করাতে পারলেইতো দেশ উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছাবে।

লেখক:
হিলারিউস মুরমু
কুনমিং, ইউনান, চায়না

আরবি. ৭ আগস্ট ২০১৮