ঢাকা ,
বার : সোমবার
তারিখ : ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
বাংলা : ৯ পৌষ ১৪৩১
Dcnewsbd Facebook
Dcnewsbd Twitter

শিরোনাম :

প্রথম পাতা শিল্প-সাহিত্য সাগর এস কোড়াইয়ার একটি ছোট গল্প “বিমুক্ত শাওন”

সাগর এস কোড়াইয়ার একটি ছোট গল্প “বিমুক্ত শাওন”

0
1361

বাড়ির ছোট সন্তান শাওন। পরিবারের বাবা মায়ের পাশাপাশি কাকা-জেঠাদের আদর যত্নে দিন দিন বেড়ে উঠতে লাগলো।

বড়দা-বড়দিই শাওনের খেলার সাথী। আর ছোট কাকা ওদের বেড়ে ওঠার সাথে আদর-শাসনে আগলে রাখা একজন বন্ধু। শাওনের বড় কাকা-জেঠারা শহরে বসবাস করার সুযোগে ছোট কাকাই ওদের বেড়ে ওঠার বন্ধু। শাওনদের বাড়ির চারপাশে প্রকৃতির কী অপরূর সুন্দর লীলাভূমি; বিশাল আকাশ যেন চারিদিকে। পাড়ায় ঘরবাড়ি কম থাকায় ও বাড়ির চারিপাশে বিশাল বিলের কারণে দূর থেকে কেউ বাড়িটিকে দেখে বলে জঙ্গল, কেউ বা বলে একটা প্রকৃতির দ্বীপ।

শাওনদের ও প্রতিবেশীদের পালন করা গরু, বাছুর ও ছাগলের বিচরণে আশেপাশের প্রকৃতিটা যেন আরো কত মায়াবী। শাওন সেই প্রকৃতির মাঝেই বেড়ে উঠছে প্রতিনিয়ত। তাদের গ্রামেই রয়েছে একটা স্কুল যেখানে প্রাথমিক শিক্ষা প্রদান করা হয়। শাওনদের বাড়ি থেকে স্কুল ঘরটা বেশকিছু দূরেই বলা যায়। বয়সের সাথে সাথে দাদা ও দিদিদের সাথে সে প্রতিদিন সকাল সাতটায় স্কুলে যাবার অভ্যাসে পরিণত করে ফেলেছে।

দিন যায়, মাস যায়, বছর যায় শাওন বেড়ে উঠছে প্রকৃতির নিয়মে আর চালিয়ে যাচ্ছে পড়াশুনা। শাওনকে তার মা প্রতিদিন সন্ধ্যাবেলা পড়াতো। আর পড়ার আগে ঠাকুরমার সাথে পরিবারের সকলেই সন্ধ্যায় রোজারি মালার প্রার্থনা করতো। শাওন বুঝতে পারতো প্রতিদিন সন্ধ্যাবেলায় প্রত্যেক পরিবারে প্রার্থনা করা একটা নিয়ম। এ নিয়মের সাথে বেড়ে উঠতে গিয়ে শাওন শিশু শ্রেণী থেকে প্রথম শ্রেণীতে, দ্বিতীয় শ্রেণীতে এভাবে উত্তীর্ণ হচ্ছে। কিন্তু হঠাৎ একদিন শাওনের চলাফেরায় কিছুটা অস্বাভিকতা লক্ষ্য করা যায়। শারীরিক অস্বাভাবিকতা; ছন্দপতন ঘটতে থাকে শাওনের পড়াশুনায়। ডাক্তারের স্মরণাপন্ন হয়ে ও বহুদিনের নানা চিকিৎসায় জানা গেল শাওন কিছুটা শারীরিক প্রতিবন্ধীতার দিকে ধাবিত হচেছ।

পরিবারে নেমে এলো আনন্দের মাঝে সীমাহীন নিদারুণ বেদনা। বাবা-মাসহ পরিবারে সকলেই বিচলিত হয়ে গেলো আর ভাবলো জন্ম নেয়া একজন সুস্থ সবল শিশু হঠাৎ কেন এমন পরিস্থিতি দেখালেন প্রভু! শাওনের যে নিজের এমন অবস্থা এবং সারাজীবন যে এভাবেই কাটাতে হবে সেটা বুঝার জ্ঞান হয়নি তখনও। ডাক্তারদের পরামর্শে শাওন শারীরিক প্রতিবন্ধীতা হলেও হাসিখুশি ভাবেই চলতে থাকলো। পড়াশুনা চালিয়ে নেবার ক্ষমতা রইল না শাওনের। কিন্তু সবকিছু বুঝতো।

একজন সুস্থ সবল মানুষ প্রতিদিন যেভাবে জীবনযাপন করতো শাওন ঠিক সেইভাবেই দিন কাটাতে লাগলো। ঘুমানো, খাবার-দাবার, খেলাধুলায় বা প্রার্থনায় প্রতিদিন সে স্বাভাবিকভাবেই পরিবারের সাথে দিন কাটাতে লাগলো; যদিও হাতের বা পায়ের শক্তিটা কম। শাওন কথা বলতে পারে কিন্তু অন্যভাবে, হাসতে পারতো মন খুলে।
শাওনের গলায় থাকতো একটি রোজারি মালা। সকাল হলেই পুরো পাড়ায় একবার করে ঘুরে আসতো; কষ্ট হতো হাটতে চলতে, তবুও। এ অবস্থায়ও মিশায় যেতো সবার সাথে। গ্রামের মানুষ শাওনের এ অবস্থায় সকলেই আদর করতো। গ্রামের রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময় সকলেই খেয়াল রাখতো শাওনকে। একদিন গ্রাম পরিদর্শণ করতে এলেন প্রতিবন্ধীদের দেখাশুনা করার দায়িত্বপ্রাপ্ত বিশপ মহোদয়। গ্রামে আরও যারা প্রতিবন্ধী রয়েছে তাদের দেখতেই এসেছেন তিনি।

কিন্তু শাওনদের বাড়ি গ্রামের একদম পশ্চিম প্রান্তের শেষ সীমানায় হওয়ায় বিশপ মহোদয়ের আসা হবে কিনা কেউ জানে না। ঈশ্বরের আশীর্বাদে গ্রামের রাস্তায় শাওনের সাথে বিশপ মহোদয়ের দেখা হয়ে গেল। নাছোড়বান্দা শাওন বিশপ মহোদয়কে হাতে ধরে টেনে তাদের বাড়ি নিয়ে এনে ছাড়লেন। শাওন বিশপ মহোদয়কে বাড়িতে আনায় সকলেই বিস্মিত হয়ে গেলেন। বিশপ মহোদয়ও খুব খুশি শাওনের এমন আন্তরিকায়।

এমন পরিস্থিতিতে শাওনের বয়স শিশুকাল পেরিয়ে বাল্যকালে তখন। হঠাৎ একদিন শাওনের মা ঈশ্বরের ডাকে সাড়া দিয়ে চলে গেলেন। যা কেউ কল্পনা করতে পারেনি। পরিবারের সকলেই দিশেহারা হয়ে গেলেন, কিভাবে শাওনকে দেখবে! শাওনের সেই জ্ঞান নেই যে মা না থাকলে কী যে কষ্ট ও অনুভূতি হয়। কিছুদিন পর থেকে পরিবার আবার স্বাভাবিক হতে থাকে আর শাওনও চলতে থাকে তার নিজের যতটুকু চলার ইচ্ছা শক্তি রয়েছে।

শাওনের দাদুর মৃত্যু বার্ষিকী; বাড়িতে সকলেই এলেন। গ্রামের প্রার্থনার দল মৃত্যু বার্ষিকীতে প্রার্থনা করতে এলেন। সকলেই প্রার্থনায় মনোনিবেশ। প্রার্থনা শেষ। সকলেই চলে গেলেন। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। শাওন বাড়ি নেই। সকলেই জানতো গ্রামের কারো না কারো বাড়িতেই আছে। সন্ধ্যা পেরিয়ে যাচ্ছে কিন্তু শাওন তো আসছে না! অনেক খোঁজাখুঁজি করে সারা রাত কোথাও পাওয়া গেল না।

সকাল হলে জানা গেল শাওন গতকাল প্রার্থনার সময় শাওনদেরই পুরোনো বাড়িতে গিয়েছিলেন। সেই চিন্তা মাথায় রেখে সকালবেলায় সেই বাড়ির আশেপাশে খুঁজতে লাগলো সকলেই। অনেক খোঁজ করার পর ভাগ্যের নিমর্ম পরিহাসে শাওনকে পাওয়া গেল ওই বাড়ির পূর্ব পাশের মরা একটা খালের কচুরিপানার পানিতে। শাওন আর নেই। পরিবারে নিস্তব্ধতা, দিশেহারা সকলেই। বুঝার বাকি রইল না যে, শাওন হাঁটতে পারতো না ঠিক মতো আর তাই বাড়ি থেকে নামতে গিয়ে হয়তো নিজের পায়ের ভর হারিয়ে ফেলে সরাসরি খালের পানিতে ডুবে গেল। এক নিদারুণ নির্মমতা সবার সামনে।

বাবা-মায়ের সাথে ছোট কাকা যে কিনা শাওনকে কোলে পিঠে করে বড় করে তুলতে সহায়তা করেছে, আদর-শাসন দিয়ে যাকে আগলে রেখেছে, বাবা মায়ের সমানই বলা চলে সেই ছোট কাকা কী করে সহ্য করবে এমন নির্মম পরিণতি! তবে একটা কথা ভেবে এটুকুই শান্ত¦না সবার, শাওন বেঁচে থাকলে হয়তো দীর্ঘজীবন তার শারীরিক প্রতিবন্ধীতা পোহাতে হতো, তার কষ্ট হতো, পরিবারের তথা গ্রামের মানুষের ভালোবাসার মায়ার জালে আরো আঁটকে যেতো। আজ শাওন মৃত্যুর মধ্য দিয়ে বিমুক্ত হয়ে যিশুর কাছে গিয়েই বরং প্রার্থনা করছে-এটাই পরিবারের কষ্টের মুক্তি॥

লেখক/ কর্মী সাপ্তাহিক প্রতিবেশী

ডিসিনিউজ/আরবি.এইচআর. ২৮ অক্টোবর ২০১৮