শিরোনাম :
সাধারণ হয়েও অমর হয়ে আছেন সবার হৃদয়ে
মানুষ বাঁচে তার কর্মে! মর্মে মর্মে বুঝিয়ে দিলেন জন রোজারিও। একজন সাধারণ মানুষ হয়েও অমর হয়ে আছেন সবার হৃদয়ে। বড় কোনো খ্যাতির জন্য তিনি লড়াই করেননি। কিন্তু অতি সাধারণ এবং নম্র কাজের মাধ্যমে তিনি সবার হৃদয়ে এখনো চির ভাস্মর হয়ে রয়েছেন। যে কবরে তিনি নিভৃতে বাতি জ্বালিয়ে প্রার্থনা করেছেন, সেখানেই তিনি শুয়ে রয়েছেন চিরশান্তিতে।
নভেম্বরের ২ তারিখে মৃতলোকের পর্বদিন। এই দিনটি এলেই মনে পড়ে মঠবাড়ী ধর্মপল্লীর ছায়াঘেরা মাল্লা গ্রামের স্বর্গীয় জন রোজারিওর নাম । তিনি টেংরাজন নামে পরিচিত। অতি সাধারণ পরিবারের মানুষ। প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া তেমন একটা ছিল না। অতি দরিদ্র খেটে খাওয়া জন রোজারিও।
এক সময় উলুখোলা বাজারে প্রতি বুধবার হাটের দিনে তার কাজ ছিল কুপিবাতি, হারিকেন, প্লেট, বাটি, হাড়ি, হ্যাজাক লাইট ঝালাই ও মেরামত করা। এসব মেরামতের কাজ করে কোন রকমে সংসার চালাতেন। তার স্ত্রীও জীবিতকালে মানুষের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে মুড়ি ভেজে স্বামীর সাথে সংসারের হাল ধরতেন। পাঁঁচ সন্তানসহ সাত জনের সংসারের ভরণপোষণই ছিল তাদের নিত্যদিনের সংগ্রাম।
জীবিতকালে প্রতি বছর তিনি নভেম্বর মাস আসার পূর্বেই মঠবাড়ী ধর্মপল্লীর সেই সময় জঙ্গলে ঘেরা কবরস্থান নিজে উদ্যোগী হয়ে পরিষ্কার করতেন। তিনি জানতেন মৃত্যুর পর তাকে এই কবরস্থানেই সমাধিস্থ করা হবে। মৃত্যুকে তিনি কখনো ভয় পেতেন না।
নভেম্বর এলেই তিনি একা সারারাত নির্জন কবরস্থানে মোমবাতি জ্বালিয়ে প্রার্থনা করতেন। গভীর রাতের নিরব-নিস্তব্ধ পরিবেশ অনুভব করতেন। কখনো তিনি ভয়ে পিছপা হননি। সেই সময়ে মঠবাড়ী কবরস্থনের জায়গাটি এত গভীর জঙ্গলে পরিবেষ্টিত ছিল যে, দিনের বেলাতেও সাধারণ পথচারী কবরস্থানের পাশ দিয়ে যেতে ভয় পেতেন। ব্যতিক্রম ছিল শুধু জন রোজারিওর বেলাতে। রাতের বেলা সেই নিভৃতে একা বসে প্রার্থনা করতেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি এই অনুশীলন করে গেছেন।
প্রায় ত্রিশ বছর তিনি নিজ উদ্যোগে তার বাড়িতে কোনো বছর বৈঠকী গানের প্রতিযোগিতা, কোনো বছর কষ্টের গান, আবার কোনো বছর সাধ্বী আগ্নেশের পালা গানের আয়োজন করতেন।
জন রোজারিও মৃতলোকের পর্বপালনের সমস্ত খরচ পূর্ব থেকেই ভাওয়ালের প্রতিটি মিশনের খ্রিস্টান বাড়ি ঘুরে ঘুরে চাল সংগ্রহ করে নিজে তা বহন করে বাড়িতে নিয়ে আসতেন। চাল বহন করার কষ্ট তাকে বিরক্ত করতে পারেনি। পর্বের একমাস পূর্ব থেকেই তার নিজস্ব কাজ রেখে চাল সংগ্রহের জন্য প্রতিদিন সকালে ঘর থেকে বের হয়ে ঘরে আসতেন সন্ধ্যাবেলা। সেই সময় যোগাযোগ ব্যবস্থা ভাল ছিল না। পায়ে হেঁটে তিনি এ কাজ করতেন। সংগৃহীত চাল বিক্রি করে পর্বের সমস্ত খরচ তিনি জোগার করতেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি এ কাজ করে গেছেন।
তার এই মহৎ কাজটি মাল্লা গ্রামবাসী এবং মঠবাড়ী ধর্মপল্লীর সকলে আজও ভুলেনি। তাই মৃত্যুর পর গ্রামবাসী তার এই মহৎ কাজটি ধরে রেখেছেন। এখন প্রতি বছর ২রা নভেম্বর গ্রামবাসীর সবার সাহায্য-সহযোগিতায় বিশেষ খ্রিস্টযাগ ও দুপুরে সবার জন্য ডাল-ভাতের আয়োজন করা হয়ে থাকে। এ বছরও ২রা নভেম্বর সমস্ত মৃতলোকের আত্মার কল্যাণে স¦র্গীয় জন রোজারিও রেখে যাওয়া ঐতিহ্য-অনুশীলন গ্রামবাসী পালন করে বিশেষ প্রার্থনা ও ডাল-ভাতের আয়োজনের মাধ্যমে। স্বর্গীয় জন রোজারিও তার অনন্য কৃতকর্মের জন্য আজও অমর হয়ে আছেন মানুষের হৃদয়ে।
তিনি মরেও বেঁচে রয়েছেন সকলের মাঝে। মানুষকে বড় হতে হলে অনেক বড় কোনো খ্যাজিত জন্য ছুটতে হয় না। ছোট ছোট কাজের দ্বারা মানুষ যে চির অমর হয়ে যান, যার মূর্তিমান প্রতীক জন রোজারিও। টাকা-পয়সা, নাম-যশ-খ্যাতির জন্য তিনি কখনো ভাবেননি। তিনি কি ভেবেছিলেন তার অজানা মহৎ কাজটি তাকে একদিন সকলের হৃদয়ে বসিয়ে দিবে! তিনি নেই, কিন্তু তার রেখে যাওয়া স্মৃতি এবং কাজ আজো সকলকে নাড়িয়ে দিয়ে যায়।
আরবি/আরপি
২৭ নভেম্বর, ২০১৬