শিরোনাম :
সংবর্ধিত হলেন বীরাঙ্গনা কানন গমেজ ও স্বর্ণলতা ফলিয়া
খ্রিষ্টান সমাজের পক্ষ থেকে সংবর্ধনা দেওয়া হলো বীরাঙ্গনা দুই নারী কানন গোমেজ ও স্বর্ণলতা ফলিয়াকে।
১৫ জুন, বিকাল সাড়ে ৪টায় মোহম্মদপুর সিবিসিবি সেন্টারে বাংলাদেশ খ্রিষ্টান ওয়েলফেয়ার সোসাইটি’র আয়োজনে ৭১’এর স্বাধীনতা যুদ্ধে নির্যাতনের স্বীকার ও যুদ্ধে অবদানকারী বরিশাল জেলার পতিহারের বীরঙ্গনা কানন গোমেজ ও গোপালঞ্জ জেলার সোনাইলবাড়ি গ্রামের বিরঙ্গনা স্বর্ণলতা ফলিয়াকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়।
সোসাইটির সভাপতি অমৃত বাড়ৈর সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বরিশাল ধর্মপ্রদেশের বিশপ লরেন্স সুব্রত হাওলাদার সিএসসি। বিশেষ অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ ওয়াইডব্লিওসিএ’র জাতীয় সম্পাদক মণীষা সরকার। এ ছাড়াও সমাজের বিশিষ্টজনেরা উপস্থিত থেকে বীরাঙ্গনা নারীদের অভিনন্দিত করেন।
বীরাঙ্গনা কানন গোমেজ স্মৃতিচারণে বলেন, ‘আমরা ভাবিনি আমাদের জীবনে এমন দিনটি আসবে। অনেক জায়গায় আমরা সম্মান পেয়েছি, কিন্তু ভাবতাম, খ্রিষ্টান সমাজ কি কোনো দিনও সম্মান দেবে না আমাদের! আজ সেই সম্মান আমরা পাচ্ছি। আমার জীবনে যে দুঃখ-ব্যাথ্যা ছিল, আজ তা দূর হয়ে গেল।’
এ সময় তিনি স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন সময়ে তাঁর উপর পাকবাহিনীর নির্যাতনের দুর্বিসহ ঘটনা বর্ণনা করেন।
কান্নাজড়িত কন্ঠে তিনি বলেন, ‘নির্যতনের পর আমরা বাড়িছাড়া হয়ে বিভিন্ন জায়গায় আশ্রয়ের জন্য ঘুরে বেড়াই। ভাত নেই, পানি নেই, সেই সময় যা পেয়েছি, খেয়েছি। সেই সময় আমি মরতেও চেয়েছি। মানুষের পরিহাস পেয়েছি।’
‘আমার এক ছেলে এক মেয়ে নিয়ে আমি অকূল পাথারে পড়েছি। কেউ আসেনি একটু সাহায্য করতে। অনেক কষ্ট করে পড়াশুনা করিয়েছি তাদের। আজও আমি ওদের নিয়ে কষ্টে দিন কাটাই’ বলেন তিনি।
বীরাঙ্গনা স্বর্ণলতা ফলিয়া যুদ্ধকালীন নির্যাতনের ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। তিনি বর্ণনা করেন কীভাবে পাকবাহিনী তাঁর উপর অমানসিক নির্যাতন চালিয়েছে।
‘যুদ্ধের পর আমি কারো কাছে আশ্রয় পাইনি। এমনকি আমার বড় বোনও আমাকে রাখেনি। আমি কি করবো বুঝতে পারছিলাম না। এক ছেলে এক মেয়ে নিয়ে আমি ভীষণ কষ্টে পড়ি। সেই সময় আমি খবরের কাগজ বিক্রি শুরু করি। রাতভর ঠোঙ্গা বানিয়ে জীবন চালিয়েছি। খ্রিষ্টান সমাজের অনেকেই ছিল, কেউ সহযোগিতার হাত বাড়ায়নি। খ্রিষ্টানদের চেয়েও ভিন্নধর্মীরা আমাদের বেশি সহযোগিতা করেছেন’ বলেন বিরঙ্গনা স্বর্ণলতা ফলিয়া।
‘আমাদের খ্রিষ্টানরা কেউ আমাদের সহযোগিতা করেননি। তখন যে-ই এসেছে, সবাই পাকবাহিনীর মতোই মনে হয়েছে’ বলেন তিনি।
সংবর্ধণা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি বিশপ সুব্রত বীরাঙ্গনা নারীদের অভিনন্দন জানান।
তিনি বলেন, ‘এই ইতিহাস শুনতে শুনতে আমার একটি বিষয় স্মরণ হচ্ছিলো, আমাদের খ্রিষ্টমন্ডলীতে যখন কাউকে সাধু বা সাধ্বী ঘোষণা করা হয়, তার আগে তাদের জীবন পর্যালোচনা করে দুটি বিষয় নিশ্চিত করা হয়। একটি হলো গুরুত্বপূর্ণ গুনাবলী, যা মানুষের জন্য প্রয়োজনীয়, দ্বিতীয়ত হলো, সেই গুনাবলী মানুষকে আকৃষ্ট করে কিনা, মানুষের কাজে আসে কিনা, সাধু-সাধ্বীদের জীবন দেখে নিজের জীবনে চর্চা করে কিনা, তখন মন্ডলী তাঁকে সাধু-সাধ্বী হিসেবে ঘোষণা করে। এই বিরঙ্গনা নারীদের মাঝে যে মহিমা রয়েছে, তা সমাজকে আলোকিত করবে।’
‘আজ বীরাঙ্গনা নারীদের ইতিহাস আমাকে স্পর্শ করেছে। ওনারা যখন বিপদে পড়েছেন, তখন তাঁরা যিশুকে ডেকেছেন, খ্রিষ্টের উপর যে ওনাদের আস্থা রয়েছে, তা ওনাদের মধ্যদিয়ে দেখেছি। কখনো কখনো তারা মানুষের সহযোগিতা পেয়েছে, কখনো কখনো মানুষের ভয়ঙ্কর রূপও দেখেছে। ওনাদের জীবন দেখে আমরা উৎসাহীত হচ্ছি। আমাদের সমাজে ওনারা নতুন দিক দান করছে’ বলেন বিশপ সুব্রত।
সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে ব্যবসায়ী হিকি ডায়েসের মতো অনেকেই বীরাঙ্গনা পরিবারকে সহযোগিতা করার আশ্বাস দিয়েছেন। বীরাঙ্গনা নারীদের ছেলে-মেয়েদের কর্মসংস্থানের সহযোগিতার জন্যও তারা আশা প্রকাশ করেন।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি, সভাপতি ও বিশেষ অতিথি বীরাঙ্গনা দুই নারীর হাতে সম্মাননা ক্রেস্ট ও আর্থিক সহযোগিতা তুলে দেন।
অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন তেজস শংকর দাস।