শিরোনাম :
মধুপুর শালবন: বন বিনাশ, জনসংখ্যাগত পরিবর্তন এবং প্রথাগত ভূমির অধিকার নিয়ে গোলটেবিল আলোচনা
॥ঢাকা প্রতিনিধি॥
“অবশিষ্ট বনাঞ্চল রক্ষা করতে হলে স্থানীয়দের সাথে এবং বিভিন্ন স্বার্থের সাথে সমন্বয় করে নীতিমালা ও আইন প্রণয়ন করতে হবে। তবে সুশাসনের অভাব ঘটলে ভালো নীতিমালা ও আইনও কাজ করবে না।” সোসাইটি ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট (সেড) এবং পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) আয়োজিত “মধুপুর শালবন: বন বিনাশ, জনসংখ্যাগত পরিবর্তন এবং প্রথাগত ভূমির অধিকার” শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে এসব কথা বলেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ।
২৯ জুলাই আগারগাঁওয়ের বন ভবনে আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে প্রধান অতিথির বক্তব্যে অধ্যাপক মাহমুদ এ বক্তব্যে বলেন, ‘আমাদের বনসম্পদ ও জায়গার পরিমাণ খুব কম। আমরা এমন জায়গায় পৌঁছেছি যে একে অপরকে দোষারোপ করে কাজ হবে না। সমন্বিত পরিকল্পনার মাধ্যমে সরকারই পারে কিছু করতে।’
গোলটেবিল বৈঠকের শুরুতে মধুপুর শালবন এলাকার ৪৪টি গ্রামের ওপর সম্পন্ন জনসংখ্যা ও আর্থ-সামাজিক জরিপ ফলাফলের সারসংক্ষেপ উপস্থাপন করেন সেড-এর পরিচালক ফিলিপ গাইন। জরিপে ফলাফল তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘এক সময়কার গারো ও কোচ অধ্যুষিত মধুপুর শালবন এলাকায় আজ বাঙালিরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। জরিপকৃত পাঁচটি ইউনিয়নের ৪৪টি গ্রামে বসবাসকারী ১১,০৪৮ পরিবারের মধ্যে বাঙালি ৬৪.৬১ শতাংশ এবং গারো ৩৫.৩৯ শতাংশ।’
তিনি আরো বলেন, ‘ভূমির দখল ও মালিকানা মধুপুর শালবন এলাকার একটি জটিল বিষয়। সেখানকার মাত্র ১৩ শতাংশ বাঙালি এবং ৪.১৯ শতাংশ গারো পরিবারের বসতভিটার দলিল (সিএস বা আরওআর) আছে। যার অর্থ হলো এ অঞ্চলের অধিকাংশ মানুষেরই বসতভিটার মালিকানা প্রথাগত বা স্বত্বদখলীয়। অন্যান্য জমির মালিকানা আছে আরো কম মানুষের। বিদেশী দাতা সংস্থার অর্থায়নে প্রাকৃতিক বন ধ্বংস করে সামাজিক বনায়নের ফলে সেখানকার শতশত স্থানীয় প্রজাতি বিলীন হয়ে গেছে। সামাজিক বনায়ন মধুপুরে বিপুল সংখ্যক বন মামলার এক বড় উৎস। জরিপকৃত ৪৪টি গ্রামে বন মামলার সংখ্যা ৩,০২৯টি যার ২১,৮৫৭টি বাঙালিদের বিরুদ্ধে এবং ৮৭২টি গারোদের বিরুদ্ধে । বন মামলার সমাধান ও বনাঞ্চল রক্ষার্থে প্রয়োজন সঠিক উদ্যোগ।’
গারো লেখক থিওফিল নকরেক গারোদের ভূমির অধিকার নিশ্চিত করা এবং হয়রানিমূলক বন মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির দাবি জানান।
তিনি বলেন, ‘বন বিভাগ ও বনবাসী মানুষের মধ্যে সাংঘর্ষিক সম্পর্কের অবসান হওয়া জরুরি। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার ১৯৫৭ সালের কনভেনশন (১০৭) ঘোষণা অনুযায়ী প্রথাগত ভূমির অধিকার নিশ্চিত করতে বন বিভাগ ও গারোদেরকে একযোগে কাজ করতে হবে।’
সাবেক প্রধান বন সংরক্ষক ইউনুস আলী বলেন, ‘সামাজিক বনায়ন শুরুর আগে থেকে বনভূমি বিনাশ চলছে। এটি নতুন কোনো বিষয় নয়। কিন্তু সামাজিক বনায়ন সারাদেশে সফল হলেও মধুপুরে তা ব্যর্থ হয়।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. তানজিমুদ্দিন খান বলেন, জমিদারি আমলের চেতনার মাপকাঠিতে বনের মানুষকে দেখলে জনগণ রাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। বিদেশী দাতা সংস্থার অর্থায়নে যেসব প্রকল্প নেয়া হয় সেগুলোর অধিকাংশই বন সংরক্ষণের বিষয়টিকে এড়িয়ে যায়। এসব প্রকল্প প্রণয়নের পূর্বেই প্রাকৃতিক বনের উপর এর প্রভাব কেমন হবে তা বন বিভাগকে বিবেচনায় নিতে হবে।’
গোলটেবিল বৈঠকের সভাপতি পিপিআরসি’র নির্বাহী পরিচালক ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, ‘পারস্পরিক স্বার্থের সমন্বয় ব্যতীত মধুপুর বন রক্ষা পাবে না। মধুপুর এলাকায় তিন ধরনের স্বার্থ রয়েছে―বন সংরক্ষণ, কৃষি এবং সেখানে বসবাসকারীদের চাহিদা সংশ্লিষ্ট স্বার্থ। এসব স্বার্থ আগে বুঝতে হবে এবং সেসবের আলোকে আলোচনার মাধ্যমে কাজ করতে হবে। এর পাশাপাশি দৃষ্টিভঙ্গিগত ভিন্নতাও দূর করতে হবে। আদিবাসীদের ভূমির সমস্যাগুলো দালিলিকভাবে সমাধান করা সম্ভব না হলেও এসডিজির দৃষ্টিকোণ থেকে তা সমাধান করতে হবে।’
এছাড়া অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন বন অধিদপ্তরের সহকারী প্রধান বন সংরক্ষক ড. মোহাম্মদ জহিরুল হক, টাঙ্গাইল বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা হারুন অর রশীদ, আচিক মিচিক সোসাইটির নির্বাহী পরিচালক সুলেখা ¤্রং, অজয় এ মৃ, ইউজিন নকরেক, বিকসন নকরেক, উন্নয়নকর্মী আব্দুল মজিদ মল্লিক, ফরিদউদ্দিন আহমেদ প্রমুখ।