শিরোনাম :
ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সঞ্চয় যেভাবে বিপদের বন্ধু
|| সুমন কোড়াইয়া ||
সুশান্ত গমেজ। ছোট একটা পদে একটা এনজিওতে চাকুরী করেন। বেতন খুব বেশি না। তার অফিসে যেতে বাসে সময় লাগে এক ঘন্টা। ঢাকা শহরের যানজটের কারণে মাঝে মাঝে বাসে সময় লাগে দেড়ঘন্টা। তিনি যে বেতন পান তাতে সংসার চলাতে কষ্ট হয়। বাসে অফিসে যেতে আসতে খরচ হয় ৪০ টাকা। তিনি অফিস শুরুর দুই ঘন্টা আগে বাসা থেকে বের হতে শুরু করলেন এবং হেঁেটই অফিসে পৌঁছালেন আরো বিশ মিনিট আগে। একই ভাবে তিনি হেঁটেই বাসায় ফিরতে শুরু করলেন। সুশান্ত সব সময় হেটে যান না, তবে বেশির ভাগ সময়ই হেঁটে অফিসে যাওয়া আসা করেন। এভাবে মনের প্রচন্ড শক্তির জোরে তিনি প্রতি মাসে অন্তত ৫শ টাকা জমা করেন একটি সমবায় সমিতির সঞ্চয়ী হিসাব নম্বরে।
আরো পড়ুন: ঢাকা ক্রেডিটে সঞ্চয় হিসাব খোলুন, সঞ্চয় করা শুরু করুন
তিন মাস পর তার সন্তানের হঠাৎ অসুখ হয়। তখন তিনি কারো নিকট হতে টাকা ধার না করেই জমানো টাকা দিয়ে ছেলেকে চিৎিসা করাতে পারলেন। সুশান্ত তার টাকা জমানোর ধারা অব্যহত রেখেছেন। তিনি শুরু হেঁটেই নয় কিন্তু সপ্তাহে একবার কম কাঁচাবাজার করে আরো ৮০-৯০ টাকা জমা করে করেন। তিনি মাসে অন্তত ৮০০ টাকা জমা করেন। বিপদে আপদে সেই টাকাই তার বন্ধু।
২) অনিতা রোজারিও’র গল্পটা অন্য রকম। তিনি গৃহিনী। তার কাজ রান্না-বান্না করা, ঘর পারিষ্কার করা, সন্তানকে খাওয়ানো, পড়ানো। তার স্বামী সকালে অফিসে যান, বাসায় ফিরেন রাত আটটার পর। স্বামীর একা আয়ে ভালভাবে সংসার চলে না। ছেলের বায়না মেটাতে হিমসিম খেতে হয় তাদের। ছেলে স্কুলের ফি দিতে কষ্ট হয়। অনিতা চিন্তা করতে শুরু করলেন কিভাবে তিনি সঞ্চয় করতে পারেন। তিনি বাজার করার দায়িত্ব নিলেন। তিনি ভেবে দেখলেন, তার স্বামী বাজার করলে বেশি বেশি বাজার করতেন এবং প্রায় সময়ই সেগুলো অপচয় হতো। তিনি বাজার করার দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রতি মাসে অন্তত ৫ শ টাকা বাঁচাতে পারেন। তিনি সেগুলো একটি প্লাষ্টিকের ব্যংকে রাখা শুরু করলেন। দুই তিন মাস পর পর সেগুলো তুলে তিনি ক্রেডিটের সঞ্চয়ি হিসাবে জমা রাখেন। বছর শেষে দেখা গেল, তিনি ছয় হাজার টাকা জমিয়ে ফেলেছেন। গতবার ছেলের বার্ষিক পরীক্ষা শেষে স্কুল থেকে সবায় যখন শিক্ষা সফরে গিয়েছিল, তখন টাকার অভাবে অনিতা ছেলেকে পাঠাতে পারেননি। এবার জমানো টাকা থাকায় সাভারের সাফারি পার্কে স্কুল থেকে আয়োজিত শিক্ষা সফরে তার ছেলে অনিতা সহ গেলেন নিশ্চিন্তে। জমানো টাকাই অনিতার আশির্বাদ হয়ে উঠলো।
(৩)
একটি এ্যম্বাসীতে কাজ করেন নিটোল রায়। বেশ ভালই মাইনে পান তিনি। তিনি ব্যাংকের সাথে এমন একটি চুক্তি করলেন যে তার বেতনের একটা অংশ একাউন্ট থেকে তার নামে নির্দিষ্ট পরিমাণে সঞ্চয় হবে। বছর শেষে তিনি সেই টাকাটি তুলে ঋণ ছাড়াই বড় একটা কিছু করতে পারেন। স্ত্রী বা বৃদ্ধ-বাবা মা অসুস্থ হলে কারো কাছে হাত না পেতেও তিনি খরচ চালিয়ে নিয়ে যেতে পারেন।
নিচে টাকা জমানোর ১৬টি কৌশলের কথা উল্লেখ করা হলো:
১। আপনি বা আপনার সঙ্গী হয়তো বাইরে খেতে পছন্দ করেন। বাইরে খাওয়াটি কমিয়ে ফেলুন। প্রতি সপ্তাহে বাইরে খেতে যাওয়ার পরিবর্তে মাসে একবার খেতে যান। এভাবে বাইরে খাওয়া বন্ধ করে টাকা জমান।
২। আমাদের ঘরে অনেক অপ্রয়োজীয় জিনিস থাকে। এসব জিনিস শুধু ঘরের জঞ্জাল বৃদ্ধি করে। দরকারি জিনিস ছাড়া অপ্রয়োজনীয় জিনিস বিক্রি করে দিন। বিক্রি করে টাকাটা জমা করে রাখুন।
৩। মাটির ব্যাংকের কথা মনে আছে? কিনে ফেলুন একটা। এখানে খুচরা বা ভাংতি টাকাগুলো জমা করে রাখুন। বছর শেষে দেখবেন বেশ ভালই জমা হয়েছে। ভাংতি টাকা রাখুন যতেœ।
৪। আমরা টাকা খরচের হিসেব রাখি না। তাই কখন, কোথায়, কী কারণে খরচ করছেন তার হিসাব রাখুন। দেখবেন, হিসাব রাখলে অতিরিক্ত খরচ কমে যাবে এমনি এমনি। তাই খরচগুলো খাতায় বা ডাইরিতে হিসেব রাখুন।
৫। যতটা সম্ভব হাটুন। হাঁটলে যেমন রিক্সা ভাড়া, বাস ভাড়া বাঁচবে তেমনি টাকাও সঞ্চয় করতে পারবেন। স্বাস্থ্যও ভাল থাকবে। চিকিৎসকের নিকট বার বার যেতে হবে না। টাকা সঞ্চয় করতে পারবেন।
৬। বাইসাইকেল চালান। এতে যাতাযাত ভাড়াটা সঞ্চয় করতে পারবেন। বাইসাইকেলে সপ্তাহান্তে বাজারও করতে পারবেন, যেখানে বাজার করে তা বাসায় আনতে রিক্সা ভাড়া বা সিএসজি ভাড়া লাগতো, সেটা বাইসাইকেল বাঁচিয়ে দিবে। এছাড়া সাইকেল চালালে যেমন বিনোদন পওয়া যায়, তেমনি অতিরিক্ত ওজনও কমে।
৭। ফাস্টফুড খাওয়া কমিয়ে দিন। কফি, বার্গার, পিৎজা, আইসক্রিম ইত্যাদি জাঙ্ক ফুড কম খেয়ে সে টাকা জমাতে পারেন।
৮। নেশা জাতীয় খাবার বর্জন করুন। সিগারেট, মদ, পান সহ যাবতীয় নেশা জাতীয় খাবার বর্জন করুন। প্রথমেই না পারলে, ধিরে ধিরে বর্জন করুন। যেখানে বন্ধু-বান্ধবরা নেশা জাতীয় খাবার নিয়ে আড্ডা দেয় সেখানে যাওয়া বাদ দিন। ভাল বন্ধুরা কখনো জোর করে নেশা জাতীয় কিছু খাওয়াবে না।
৯। সংসারের আর্থিক অবস্থা নিয়ে জীবন সঙ্গীর সাথে সহভাগিতা করুন। তাকে বলুন এই মাসে এত আয়, এই টাকা দিয়েই মাস চলতে হবে। আপনার সঙ্গী, সন্তানরা আপনার আর্থিক অবস্থার কথা জানা থাকলে তারাও খরচের ব্যপারে সজাগ থাকবেন। অযৌতিক আবদার করবেন না।
১০। অফিসে যাওয়ার জন্য সহজ এবং কম খরচের যানবাহন ব্যবহার করুন। এটি একটি অন্যতম টাকা জমানোর কৌশল । গাড়ি থাকলে জ্যামে পড়লে গাড়ির স্টার্ট বন্ধ করে রাখুন। এতে আপনার তেল খরচ অনেক কমে যাবে।
১১। অনেকে অতিরিক্ত বড় বাসায় ভাড়া থাকেন। প্রয়োজন না হলে বড় বাসা না নেওয়াই ভাল। আপনার পরিবারের জন্য যেটুকু প্রয়োজন সেরকম দেখে কোন বাসা পছন্দ করুন। প্রয়োজনে সাবলেট নিন। এতে খরচ কমবে। বাসা আপনার অফিস, বা বাচ্চাদের স্কুলের কাছে হলে আরও ভাল।
১২। বাসাতে খুব বেশি প্রয়োজন না হলে লাইট, ফ্যান, এসি অন করে রাখবেন না। দেখবেন মাস শেষে বিদুৎ বিল কম এসেছে।
১৩। কারো জিনিসপত্র দেখলেই নিজেরও সেরকম কিছু কিনতে হবে, এই মন মানসিকতা পরিহার করতে হবে। কেউ দশ হাজার টাকা দামের শাড়ি কিনলে আপনাকে বার হাজার টাকা দামের শাড়ি কনতে হবে এই চিন্তা ধারা বাদ দিতে হবে। কম দামে রুচিশীল শাড়ি বা পোশাক কিনুন।
১৪। বাজার করতে যাওয়ার আগে তালিকা তৈরি করুন। তাহলে অপ্রয়োজনীয় দ্রব্য কেনা থেকে বিরত থাককেন।
১৫। বারান্দা কিংবা ছাদের এককোণে সবজি বাগান করতে পারেন। এই ছোট বাগানটি সবজি কেনার খরচ কমিয়ে দেবে। এটা যেমন আপনার খরচ কমাবে তেমনি আপনার অবসর সময়ে হালকা পরিশ্রম করারও একটা সুযোগ তৈরী করবে।
১৬। সপ্তাহের একটি দিন ঠিক করুন আপনি বাসা থেকে কোথাও বের হবেন না, ঘরে যা আছে তা দিয়েই দিন চালিয়ে দিবেন, দেখবেন খরচ কমেছে।