শিরোনাম :
প্রেস ব্যবসায়ী লিংকন গমেজের সফলতার গল্প
|| হিমেল রোজারিও ||
মতিঝিলের আরামবাগের ডট প্রিন্টার্সে ঢুকতেই নাকে এলো নতুন কাগজের গন্ধ। ভিতরে চারটি প্রিন্টিং মেশিন রয়েছে। তার মধ্যে তিনটিতেই চলছে ছাপার কাজ। পাঁচজন কর্মী মনোযোগ দিয়ে কাজ করছেন। কেউ মেশিনে প্লেট লাগাচ্ছেন, কেউ প্লেটে কালি লাগাচ্ছেন, আবার কেউ প্রিন্টের পরে দেখছেন কোথায়ও কোনো ত্রুটি আছে কিনা। গলির পাশেই আরেকটি কক্ষে ছাপা হওয়া কাগজগুলো সুনিপুণভাবে কাটছেন একজন কর্মী, আবার কয়েকজন আঠা লাগাচ্ছেন। এরই মধ্যে উপস্থিত হলেন ডট প্রিন্টার্সের কর্ণাধার লিংকন গমেজ। তিনি একটি মিষ্টি হাসি দিয়ে অভিবাদন জানালেন আমাদের।
লিংকন গমেজের জন্ম চট্টগ্রামের আগ্রাবাদে হলেও বেড়ে উঠেছেন ঢাকা শহরে। এর মধ্যে দুই বছর কেটেছে ঘোড়াশালের পলাশে। প্রায় ৪৫ বছর আগে পরিবার নিয়ে চলে আসেন ঢাকায়। বাবা ইলেকট্রনিক্স কাজ করতেন। বিশেষ করে ফ্রিজ ও এসির কাজগুলো করতেন। ওয়ারিতে প্রথমে ভাড়া বাসাতে থাকতেন এবং স্কুলে পড়াশোনা করতেন। মাধ্যমিক পাঠ চুকিয়ে নটর ডেম কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন। কিন্তু উচ্চমাধ্যমিক পাশ করা হয়নি। মামা রোমান গমেজ হলিডে প্রিন্টার্স-এ কাজ করতেন। তাই ভাগিনা লিংকনকে নিজের সঙ্গে কাজ করার জন্য নিয়ে যান। লিংকন অল্প কিছুদিনের মধ্যে নিজেকে প্রিন্টিং প্রেসের পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নেন। পরবর্তীতে গ্রাফিক্স ডিজাইনের উপর একটি ডিপ্লোমা করেন মোহম্মাদপুরে।
আরো পড়ুন: শপথ নিলেন কাককো’র নবনির্বাচিত ব্যবস্থাপনা পরিষদের ১৫ জন সদস্য
১৯৯২ সালে লিংকন প্রথমে হলিডে প্রিন্টার্সে কাজ করার সময় চিন্তা করে দেখলেন বেশ কিছু বাড়তি সময় থাকে। সেই সময়টুকু কাজে লাগানোর জন্য আরেকটি চাকরি নিলেন ‘দৈনিক ইনকিলাব’ অফিসে। একটি করতেন দিনে, অন্যটি মধ্যরাত পর্যন্ত। কাজ করতে করতে মাথায় একটি নিজস্ব প্রিন্টিং প্রেস করার পরিকল্পনা আসে। কিন্তু মূলধনের যোগান তেমন ছিল না। তাই মা এলিজাবেথ গমেজের বই থেকে ঢাকা ক্রেডিট হতে প্রথমে ৩০ হাজার টাকা ঋণগ্রহণ করে ১৯৯২ সালে মতিঝিলের আরামবাগে ‘ডট প্রিন্টার্স’ নামে ছোট পরিসরে একটি প্রিন্টিং প্রেস শুরু করেন। লিংকন কখনোই সমবায় সমন্ধে তেমন কোনো আগ্রহ প্রকাশ করেনি। কিন্তু মা তার জন্য একটি সঞ্চয়ী হিসাব খুলে দিয়েছিলেন কিন্তু সদস্য পদ গ্রহণ করেননি।
আরো পড়ুন: ব্যবসায় ঋণ পেতে…
চার ভাই-বোনের মধ্যে সবার বড় হওয়ার পরেও খুব বেশি দায়িত্ব পালন করতে হয়নি। বাবার উপার্জিত অর্থ দিয়ে মোটামুটি পরিবারের ভরণ-পোষণ হয়ে যেতো। তাই লিংকনের বাবা কখনোই তার কাছে থেকে পরিবারের ভরণ পোষণের জন্য টাকা চাননি। ধীরে ধীরে ডট প্রিন্টার্সের পরিচিতি বাড়তে থাকে। এর সাথে প্রেসের আকারও বৃদ্ধি পেতে থাকে। লিংকন নামীদামি কোম্পানির কাজ পেতে থাকেন। লিংকনকে আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি এর পর থেকে। প্রাণ কোম্পানী বিভিন্ন পণ্যের ছবি, লোগো, বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর ক্যালেন্ডার, ডায়েরি, বই, ম্যাগাজিন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কাজও করেছে ডট প্রিন্টার্স।
অন্যান্য ব্যবসায়ের মতো প্রিন্টিং ব্যবসায়েও কিছু ঝুঁকি রয়েছে। ঝুঁকির বিষয়ে লিংকন বলেন, আগে প্রাণ কোম্পানিসহ বিভিন্ন কোম্পানির কাজ করতেন। বর্তমানে প্রাণ কোম্পানির মতো বিভিন্ন কোম্পানি তাদের প্রিন্টিং প্রেস তৈরি করে নিয়েছে। সেই কারণে সে কাজগুলো এখন আর পাওয়া যাচ্ছে না। মানুষের সাথে ভালো সম্পর্ক, সময় মতো অর্ডার সম্পন্ন করা, মানসম্মত কাগজে মানসম্মত কালি ব্যবহার করলে পরবর্তীতে অর্ডার পেতে সমস্যা হয় না। কর্মচারীদের সঠিকভাবে দিক-নির্দেশনা এবং সময় মতো বেতন পরিশোধ করার কারণে কোনো প্রকারের সমস্যায় পড়তে হয়নি শ্রমিক নিয়ে। ছোট-বড় সব মিলিয়ে ১৪জন কর্মচারী কাজ করছে প্রেসে।
অনেক সময় কোটি টাকার উপরে ছাপার কাজের অর্ডার পেলে কাঁচামাল (কাগজ) ক্রয়ের জন্য একটু সমস্যায় পড়তে হয় বলে তিনি জানান। আবার কাজ ডেলিভারি দেওয়ার সাথে সাথে টাকা পাওয়া যায় না। দু-এক সপ্তাহ দেরি হয়। বর্তমানে বড় ধরনের কাজের অর্ডার পেলে ঢাকা ক্রেডিট থেকে সিসি ঋণ নিয়ে এই সমস্যার সমাধান করছেন লিংকন।
প্রেসে মেশিন ম্যান, বাইন্ডিং, আঠা লাগানো কোনো কাজই লিংকন শিখেননি। তিনি শিখেছিলেন ডিজাইনের এবং প্রিন্ট ব্যবস্থাপনার কাজ। তাই নিজে কর্র্মীদের সঙ্গে থেকে ভালো মতো নির্দেশনা প্রদান করে কাজ করিয়ে নেন। প্রিন্টিং ব্যবসায় ভালো লাগার কারণে বাবার অনুরোধও প্রত্যাখান করেছেন লিংকন। তার বাবা চেয়েছিলেন লিংকন ইলেকট্রনিক্স’র কাজ করুক। নিজের ইচ্ছায় বেছে নেওয়া পেশায় লিংকন অনেক আনন্দের নিয়ে ব্যবসায় পরিচালনা করছেন। তিনি বলেন, চাকরি করলে হয়তো নিজস্ব ফ্ল্যাট, জমি, মোটর বাইক গাড়ি ক্রয় করতে পারতাম না। প্রিন্টিং ব্যবসায় করে দুই মেয়ে, এক ছেলেকে লেখাপড়া করাচ্ছি। বড় মেয়েটি নটর ডেম বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবিএ’তে অধ্যায়ন করছেন। ছেলে নটর ডেম কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র এবং ছোট মেয়ে নবম শ্রেণির ছাত্রী। চাকরি করলে হয়তো এক লক্ষ টাকা বেতন পাওয়া যেতো। শুধু চাকরি করে ঢাকা শহরে থেকে ছেলে-মেয়েকে পড়াশোনা করানো অনেক কঠিন হয়ে পড়তো।
যারা প্রিন্টিং ব্যবসায়ে আসতে আগ্রহী তাদের উদ্দেশে লিংকন বলেন, ভালো ক্লাইন্ট, দক্ষ মেশিনম্যান, ভালো ও সৎকর্মীবাহিনী থাকা প্রয়োজন। ভালো কর্মীকে বেতন একটু বেশি প্রদান করলেও সমস্যা নেই। যদি পর্যাপ্ত মূলধন না থাকে তাহলে বিভিন্ন ক্রেডিট থেকে ঋণগ্রহণ করতে পারে। সেই সাথে সময়মতো ঋণের কিস্তি প্রদান করা এবং প্রয়োজন মাফিক অর্থ খরচ করাও একটি দায়িত্ব।
মতিঝিলে অনেক ব্যাংক থাকা সত্ত্বেও লিংকন কেন ঢাকা ক্রেডিট থেকে ঋণগ্রহণ করেছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ব্যাংক এবং ক্রেডিট ইউনিয়ন ভিন্ন অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান। ব্যাংক থেকে ৮০ লক্ষ টাকা ঋণগ্রহণ করতে গেলে বিভিন্ন সেক্টরে বকশিস প্রদান করতে হতো। যতদিন মেয়াদে ঋণগ্রহণ কবরো সেই মেয়াদের আগে ঋণ পরিশোধ করা যাবে না, আর পরিশোধ করা গেলেও সেই মেয়াদের সুদ পরিশোধ করতে হয়। ঢাকা ক্রেডিট থেকে ঋণ গ্রহণ করার পরে যে কোনো সময়ে ঋণ পরিশোধ করার সুযোগ রয়েছে। যতদিন টাকা ব্যবহার করবো ততদিনের সুদ প্রদান করতে হয়। ঢাকা ক্রেডিটের চেয়ে ব্যাংকের সুদের হার তুলনামূলক একটু বেশি।’
‘এছাড়া কিছু কিছু সমবায় সমিতিতেও ঢাকা ক্রেডিটের চেয়ে বেশি ঋণের সুদ প্রদান করতে হয়। সময় মতো কিস্তি প্রদান করলে রিবেট পাওয়া যায় ঢাকা ক্রেডিট থেকে। যা ব্যাংক থেকে পাওয়া যায় না। ঢাকা ক্রেডিটের সিসি ঋণ প্রকল্পটি বেশি উপকারী ব্যবসায়ীদের জন্য। কারণ যখন বড় ধরনের কাজের অর্ডার আসে তখন ঋণগ্রহণ করা যায় এবং পেমেন্ট পেলে দুই-তিন মাসের মধ্যে সেই ঋণ পরিশোধ করা যায়। ব্যাংক থেকে যখন তখন ঋণগ্রহণ করা যায় না। যদি সিসি ঋণের সুদের পরিমাণ একটু কম হতো তাহলে সুবিধা হতো ব্যবসায়ীদের জন্য’ যোগ করেন তিনি।
তিনি ঋণ খেলাপিদের উদ্দেশে বলেন, কারো বইয়ের জামিন নিয়ে ঋণগ্রহণ করার পরে কিস্তি প্রদান না করলে জামিন প্রদানকারী ব্যক্তি মনোক্ষুন্ন হন। তাই নিজে না খেয়ে থাকলেও সময় মতো কিস্তি প্রদান করা উচিত। সময় মতো কিস্তি প্রদানের ফলে ঢাকা ক্রেডিট থেকে সর্বদা ঋণের আবেদন করে ঋণ পেয়েছি, কখনো বিফল হইনি।
ডট প্রিন্টার্সের মালিক লিংকন ঢাকা ক্রেডিটের প্রশংসা করে বলেন, ‘ঢাকা ক্রেডিট বর্তমানে হাসপাতাল, চাইল্ড কেয়ার, স্কুল, বহুমুখী যে প্রকল্পগুলো গ্রহণ করেছে তা খ্রিষ্টান সমাজের মানুষের জন্যই করেছে। এটি নিঃসন্দেহে একটি ভালো উদ্যোগ।’
বর্তমানে ছেলে-মেয়ে ও স্ত্রী নিয়ে নিজস্ব বাড়িতে আছেন। আগামি কয়েক মাসের মধ্যে রাজধানীর ভাটারা থানায় নিজস্ব ক্রয়কৃত জমিতে একটি বাড়ি নির্মাণ করবেন। এই জমিও ক্রয় করেছিলেন ঢাকা ক্রেডিট থেকে ঋণ নিয়ে। আর এখন বাড়িও তৈরি করতে যাচ্ছেন ঢাকা ক্রেডিট থেকে ঋণ নিয়ে॥
আরো পড়ুন:
ময়মনসিংহে চাকরি দেওয়ার নাম করে খ্রিষ্টান গারো তরুণীকে ধর্ষণ চেষ্টা