ঢাকা ,
বার : বুধবার
তারিখ : ২৫ ডিসেম্বর ২০২৪
বাংলা : ১১ পৌষ ১৪৩১
Dcnewsbd Facebook
Dcnewsbd Twitter

শিরোনাম :

প্রথম পাতা দেশ আজ ঈশ্বরের সেবক টি. এ. গাঙ্গুলীর ৪২তম মৃত্যু বার্ষিকী

আজ ঈশ্বরের সেবক টি. এ. গাঙ্গুলীর ৪২তম মৃত্যু বার্ষিকী

0
803

|| হিমেল রোজারিও ||

আজ আর্চবিশপ থিওটোনিয়াস অমল গাঙ্গুলীর (টি. এ. গাঙ্গুলী) ৪২তম মৃত্যু বার্ষিকী। তিনি দেশের প্রথম বাঙালি সাধু শ্রেণীভুক্তকরণের প্রথম ধাপ ‘ঈশ্বরের সেবক’ পদে ভূষিত হয়েছেন ২০০৬ সালে।

ঢাকা জেলার নবাবগঞ্জ থানার হাসনাবাদ ধর্মপল্লীর হাসনাবাদ গ্রামে নিকোলাস কমল এবং রোমানা কমলা গাঙ্গুলীর কোল জুড়ে ১৯২০ সালে ১৮ ফেব্রুয়ারি জন্ম গ্রহণ করেন অমল গাঙ্গুলী। ২৬ ফেব্রুয়ারি হাসনাবাদ গির্জায় দীক্ষাস্নানের সময় ‘ থিওটোনিয়াস ’ নাম রাখা হয়। দশ বছর বয়সে ১৯৩০ সালের ৯ জুন হস্তার্পণ সাক্রামেন্ত গ্রহণ করেন। তিন ভাইয়ের মধ্যে অমল ছিলেন পিতা-মাতার দ্বিতীয় সন্তান। বাবা নিকোলাস গাঙ্গুলী কলকাতায় চাকরি করার সুবাদে ১৯৩০ সালের শেষের দিকে স্বপরিবারে কলকাতায় পাড়ি জমান।

বালক অমল তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত হাসনাবাদ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। এর পর বান্দুরা হলিক্রস হাইস্কুলে ভর্তি হন। মেধাবী ছাত্র হওয়ায় প্রতিটি ক্লাসে প্রথম স্থান লাভ করতেন। ১৯৩৭ সালের শুরুতে অষ্টম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হয়ে ক্ষদ্রপুষ্প সাধ্বী তেরেজোর সেমিনাীতে প্রবেশ করেন। ১৯৪০ সালে কৃতিত্বের সাথে ম্যাট্রিক (এসএসসি) পাশ করেন। ১৯৪০ সালের জুলাই মাসে ভারতের বিহারের রাঁচীতে সেন্ট আলবার্ট সেমিনারীতে যান। ১৯৪০ সালে জুলাই থেকে ১৯৪১ সালের জুলাই পর্যন্ত জুনিওরেট কোর্স সম্পন্ন করেন। ১৯৪১ সালে জুলাই মাস থেকে ১৯৪৩ সালের ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত দর্শন শাস্ত্র অধ্যয়ন করেন। এর পর ১৯৪৬ সালের জুন মাস পর্যন্ত ঐশতত্ত্ব বিষয়ে পড়াশোনা করেছেন। ১৯৪৬ সালের ৬ জুন মেধাবী ছাত্র থিওটোনিয়াস অমল গাঙ্গুলী বিশপ অস্কার সেভরিন কর্তৃক সেন্ট মেরীস ক্যাথিড্রালে যাজক পদে অভিষিক্ত হন। ১৯৪৭ সালের ২৮ জুলাই ফাদার থিওটোনিয়াস অমল গাঙ্গুলী নটর ডেম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ ডিগ্রী লাভ করেন। এর পরে ১৯৪৯সালে ৩১ জানুয়ারি এমএ ডিগ্রী লাভ করেন। একই বিশ্ববিদ্যালয় হতে ১৯৫১ সালে পিএইচডি (ডক্টরেট) ডিগ্রী লাভ করেন। তিনি ‘মহর্ষি পতঞ্জলি’র যোগ বিষয়ের উপর গবেষণা করেন। ‘পুরুষ ও প্রকৃতি: পতঞ্জলি, সংখ্যা ও যোগ- এর আলোকে একটি দার্শনিক মূল্যায়ন’ ছিল তার থিসিস বিষয়। তিনি বাংলা, ইংরেজি ভাষা ছাড়াও লাতিন, ফরাসি, জার্মান, ইতালীয়, উর্দু,  হিন্দি ও সংস্কৃত ভাষায় দক্ষ ছিলেন।

ডক্টরেট ডিগ্রী লাভ করার পর পরই আর্চবিশপ লরেন্স গ্রেনার সিএসসি’র অনুমতি ক্রমে ১৯৫১ সালের ১৫ আগস্ট পবিত্র ক্রুশ সংঘের নভিশিয়েটে প্রবেশ করেন। একবছর কৃচ্ছ্র সাধনার পরে ১৯৫২ সালের ১৬ আগস্ট ফাদার থিয়োটিয়াস অমল গাঙ্গুলী পবিত্র ক্রুশ সংঘের সংবিধান অনুযায়ী ব্রত গ্রহণ করেন। ১৯৫৫ সালের ২৬ অক্টোবর পবিত্র ক্রুশ সংঘের চিরব্রত গ্রহণ করেন।

টি. এ. গাঙ্গুলী ছিলেন প্রথম পিএইচডি ডিগ্রিধারী খ্রিষ্টান বাঙালি। স্বল্পভাষী কিন্তু বহুভাষাবিদ, সুশিক্ষিক, লেখক, বক্তা, গায়ক, এবং চিন্তাবিদ। উচ্চ শিক্ষা ও জ্ঞানের অহংকার কোন দিনই তাঁকে স্পর্শ করতে পারেনি। কর্মজীবন শুরু হয় যাজকীয় অভিষেকের পর। বাংলাদেশে আসার পরে ১৯৪৬-১৯৪৭ সাল পর্যন্ত বান্দুরা ক্ষুদ্রপুষ্প সাধ্বী তেরেজা সেমিনারীতে সহকারী পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন।

১৯৫২ সাল থেকে তিনি নটর ডেম কলেজে অধ্যাপনা শুরু করেন। পরবর্তীতে ১৯৫৮ সালে কলেজের সহকারী অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন। নটর ডেম কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ জেমস মার্টিনের  মৃত্যুর পর ১৯৬০ সালের ২১ মার্চ কলেজটির প্রথম বাঙালি অধ্যক্ষ হিসেবে নিযুক্ত  হন। কিন্তু বেশিদিন এ পদে থাকতে পারেননি। ঢাকার আর্চবিশপ লরেন্স লিও গ্রেনারের সহকারী নিযুক্ত হওয়ায় সেই বছরের ৩ সেপ্টেম্বর অধ্যক্ষের পদ ছেড়ে দেন।

১৯৬০ সালের ৩ সেপ্টম্বের ফাদার থিওটোনিয়াস অমল গাঙ্গুলী পোপ ত্রোয়োবিংশ যোহনের পত্রের মাধ্যমে জানতে পারলেন যে তাঁকে বিশপ হওয়ার জন্য মনোনীত করা হয়েছে। একই বছরের ৭ অক্টবর বিশপ অভিষেক অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়। তিনিই প্রথম বাঙালি বিশপ হিসেবে নিযুক্ত হয়েছেন। ১৯৬৭ সালের ২৩ নভেম্বর ঢাকা মহাধর্মপ্রদেশের প্রথম বাঙালি আর্চবিশপ হিসেবে নিযুক্ত হন। ১৯৬১ সালের ২১ জানুয়ারি তাকে নাগরিক সংবর্ধনা প্রদান করা হয়। তিনি তাঁর নেতৃত্ব, জ্ঞান, প্রজ্ঞার যোগ্যতা বলে ‘আর্চবিশপ’ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি আর্চবিশপ লরেন্স লিও গ্রেনার, সিএসসি’র স্থলাভিষিক্ত হন। তিনি ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত আমৃত্যু এই দায়িত্ব পালন করেন। 

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে তিনি বুদ্ধিজীবীদের তালিকায় ছিলেন। মুক্তিযোদ্ধাদের তিনি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সাহায্য করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তিনি  খ্রিষ্টানদের  বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিদের নির্দেশ দিয়ে ছিলেন যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্থদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য। তিনি নিজের জীবন বিপন্ন করে দেশের বিভিন্ন স্থানে পায়ে হেঁটে, সাইকেলে চেপে টাকা পয়সা ও খাবার পৌঁছে দিয়েছেন।

১৯৭২ সালে ২ ফেব্রুয়ারি আর্চবিশপ টি. এ. গাঙ্গুলীর নেতৃত্বে বাংলাদেশের কাথলিক ও প্রটেষ্টান মন্ডলীর ছয়জন নেতা সদ্য স্বাধীন দেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে তাঁর অফিসে সাক্ষাৎ করেন এবং এদেশের ত্রাণ ও পুনবার্সনের জন্য দুই লক্ষ টাকার একটি চেক এবং এদেশের উপর ঈশ্বরের আর্শীবাদের প্রতীকস্বরূপ একটি স্বর্ণের ক্রুশ ও তাঁর গলার চেইন প্রদান করেন।

আর্চবিশপ টি. এ. গাঙ্গুলীর স্মৃতি ধরে রাখার জন্য গড়ে উঠেছে বিভিন্ন সংঘ ও সমিতি। ঢাকা খ্রীষ্টান ছাত্র কল্যাণ কল্যাণ সংঘ প্রতি বছর তাঁর নামে বিতর্ক প্রতিযোগিতার আয়োজন করে থাকে। ২০০৯ সালে কাথলিক মন্ডলী কর্তৃক স্থাপিত ‘টি. এ. গাঙ্গুলী টিচার্স ট্রেনিং কলেজ’ নামকরণ করেন। ২০১৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যায়ের বিশ্ব ধর্ম ও সংস্কৃতি বিভাগে ‘আর্চবিশপ টি. এ. গাঙ্গুলী লাইব্রেরী’ যাত্রা শুরু করে। তাঁর স্মৃতিকে অমর করে রাখতে ঢাকার নটর ডেম কলেজের একটি ভবনের নামকরণ করা হয়েছে ‘আর্চবিশপ গাঙ্গুলী ভবন’।

১৯৭৭ সালের ২ সেপ্টেম্বর হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত্যু বরণ করেন। তাঁর মৃত্যুতে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান তাঁর শোক বাণীতে বলেন, ‘প্রখ্যাত কাথলিক নেতা আর্চবিশপ টি. এ. গাঙ্গুলীর দুঃখজনক মৃত্যুতে আমি গভীরভাবে ব্যথিত। বাংলাদেশ ও তার জনগণের জন্য তাঁর অবদানের কথা গভীর শ্রদ্ধার চোখে দেখা হয়ে থাকে।” রমনা আর্চবিশপ প্রাঙ্গণে তাঁকে সমাহিত করা হয়।

টি. এ. গাঙ্গুলীর ২৯তম মৃত্যু বার্ষিকীতে ২০০৬ সালের ২ সেপ্টেম্বের ভাতিকান থেকে পোপ ষোড়শ বেনেডিক্ট তাঁকে ‘ঈশ্বরের সেবক’ উপাধি প্রদান করেন। ধর্মীয়ভাবে সর্বোচ্চ ত্যাগের ও অবদানের জন্য পোপ মৃত ব্যক্তিদের বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সাধু ঘোষণা করে থাকেন। সাধু শ্রেণিভুক্তকরণের প্রথম ধাপ হচ্ছে ‘ঈশ্বরের সেবক’ পদ। এই পদে তারাই সম্মানিত হন যারা সেবা, ভালবাসা, ক্ষমা, সততা ও পবিত্র জীবন যাপন করে থাকেন।

আর্চবিশপ টি এ গাঙ্গুলীর কাছে প্রার্থনা করে উপকৃত হয়ছেন অনেকে। তাদের মধ্যে ঢাকার মগবাজারের ভেরোনিকার পেটে ব্যথা হওায়ায় ডাক্তারের স্মরণাপন্ন হন। ডাক্তারের ঔষধে ভালো না হওয়া টি. এ. গাঙ্গুলীর নিকট প্রার্থনা করে সুস্থ হয়েছেন। এছাড়া মাউসাউদ ধর্মপল্লীর রাজাবাড়ি গ্রামের সেলিনা রোজারিও, রুবি উমেল্ডা গমেজ প্রার্থনা করে ফল লাভ করেন।

নটর ডেম বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের রেজিষ্টার ফাদার আদম এস পেরেরা সিএসসি ডিসি নিউজকে বলেন, ‘আমি সেমিনারীতে প্রবেশের পরে আর্চবিশপ টি. এ. গাঙ্গুলীকে কাছে থেকে দেখার কিছুটা সময় হয়েছিল। তিনি সেমিনারীয়ানদের সর্বদা অনুপ্রেরণা দিতেন। তাঁর অনুপ্রেরণায় আমরা অনেকে যাজক হতে পেরেছি। তাঁর পবিত্র জীবন-যাপন আমাকে অনেক আকৃষ্ট করে। বাংলাদেশ মন্ডলীর ভিত্তি প্রস্তর তিনিই প্রথম বিশপ এবং আর্চবিশপ হিসেবে স্থাপন করে গিয়েছেন। মন্ডলীর পালকীয় এবং শিক্ষা ক্ষেত্রে তার অবদান অনস্বীকার্য। তাঁর প্রতি বিশেষ ভালোলাগা থেকেই তাকে নিয়ে আমি একটি বই ‘দিবালোকের উজ্জ্বল নক্ষত্র থিয়োটনিয়াস অমল গাঙ্গুলী’ লিখেছি । আমাদের প্রার্থনা ও তার কর্মকে প্রচারের মাধ্যমেই টি. এ. গাঙ্গুলীতে ঈশ্বরের সেবক থেকে সাধু হিসেবে পেতে সাহায্যে করবে।

আজ বিকাল সাড়ে পাঁচটায় ঈশ্বরের সেবক টি. এ. গাঙ্গুলীর মৃত্যু বার্ষিকী উপলক্ষে বিশেষ খ্রিষ্টযাগ উৎসর্গ করা হবে।