ঢাকা ,
বার : সোমবার
তারিখ : ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
বাংলা : ৯ পৌষ ১৪৩১
Dcnewsbd Facebook
Dcnewsbd Twitter

শিরোনাম :

প্রথম পাতা সম্পাদকীয় উপ-সম্পাদকীয় নকল করে সুর সৃষ্টি করা যায় না: সমর দাস

নকল করে সুর সৃষ্টি করা যায় না: সমর দাস

0
1909

সেই আগেকার পরিবেশ আমাদের সঙ্গীত জগতে আজকাল আর নেই। সেই সময় আমদের একটা কিছু সৃষ্টি করতে পরিশ্রম ও ত্যাগ স্বীকার করতে হতো। বিশেষ করে তখনকার সঙ্গীত ছিল কঠোর সাধনার। বিনা সাধনায় কিছুই করা সম্ভব হতো না।
খেটে খুটে সাধ্য সাধনা করে তখন যা সৃষ্টি করতে পারতাম তার তুলনা হতো বিরল ছিলনা, কিন্তু সে সৃষ্টিতে স্রষ্টার যেমনি মন ভরতো তেমনি শ্রোতারও মনে দোলা দিতো। এবং তা দীর্ঘস্থায়ী এমনকি চিরস্থায়ীও হতো বলা চলে।
আর এখন- পপ মিউজিক, বিট মিউজিকের যুগে ইলেকট্রনিক্সের কলা- কৌশলে যে কেউ যেনতেনভাবে এক আধটু চেষ্টা করলেই একটা চমক লাগানো কোন কিছুর সৃষ্টি করতে পারে বা তাৎক্ষণিক ভাল লাগে। কিন্তু খানিক পরেই ঐ আপাত সৃষ্টির মূর্চ্ছনা শ্রোতার মন হতে উবে যায়। গানের কথা হয়তো ভালো কিন্তু সুর তেমন নয়। আবার সুর খুবই চমকপ্রদ, কিন্তু শব্দ মানানসই নয় যার ফলে আজাকল সঙ্গীতে প্রাণ সঞ্চার হতে পারে না। শ্রোতারাও গানের সুরে জীবন্ত রূপ খুঁজে পায় না। যা খুব সহজে সৃষ্টি করা হয়, আরো সহজেই তা মিলিয়ে যায়।
ওপরের কথাগুলো বলেন প্রবীণ স্বনামধন্য সুরকার সমর দাস। শিল্পীর জন্ম ঢাকার লক্ষ্মীবাজারে ১৯২৫ সালে। তিনি ছিলেন সেন্ট গ্রেগরী স্কুলের ছাত্র। কলেজ জীবন কেটেছে কোলকাতায়। সঙ্গীত জগতে আগমন প্রসঙ্গে বলেন, বাবা ছিলেন ধার্মিক মানুষ। বাদ্যযন্ত্রের একটি দোকান ছিল বাবার। সে দোকানে যখন তখন যাতায়াত ছিল আমার। ফলে এটা সেটা বাজাতে চেষ্টা করি। এমনি করে পিয়ানো বাজাতে সক্ষম হই। সেই থেকে পিয়ানো আমার প্রিয় বাদ্যযন্ত্র।
বাদ্যযন্ত্রের মধ্যে হাওয়াই গীটার এবং বাঁশিও বাজাতে পারতাম। তখন কোলকাতায় সঙ্গীত সম্মেলন-জলসা ইত্যাদিতে উপস্থিত থাকতাম আর তা উপভোগ করতাম। এমনি করেই একদিন পরিচয় হয় হিজ মাষ্টার ভয়েজ এন্ড জেডি নিউম্যান নামক এক ভদ্রলোকের সঙ্গে। তাঁর সংস্পর্শে এসে আমি অনেক উপকৃত হই। ঐ গ্রামোফোন কম্পানিতে কমল দাস গুপ্ত, বিশেষ করে অনুপম ঘটক আমাকে সুরের জগতে গড়ে তোলেন। সে সময় তাঁদের সাথে সাথে বেশ কয়েকটা ছায়াছবির সুর সংযোজনের কাজ করি। এর মধ্যে ‘অগ্নি পরিক্ষা’ ও ‘চন্দ্র শেখর উল্লেখযোগ্য। কালিপদ সেনের সঙ্গে ‘লটারী’ ছায়াছবিতে সঙ্গীত পরিচালকের দায়িত্ব পালন করি। ‘শিল্পীর স্বপ্ন’ নামক অপর একটি নৃত্য নাট্য নিজেই পরিচালনা করি ও সুর সংযোজন করি। এটি বেশ প্রশংসা কুড়িয়েছিল। ঐ নৃত্য নাট্যের জুটি ছিলেন অনাদিপ্রসাদ ও জয়প্রসাদ সেন।


বিদেশী যন্ত্রসঙ্গীত ও ক্লাসিক্যাল, সাইন্টিফিক ও ম্যালডিক্যাল আমার দারুন পছন্দ। এসব উন্নমানের সুর নিয়ে শচীন দেব বর্মন ও নওশাদ উপমহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের পল্লী সুরকে আরও সমৃদ্ধ করতে পেরেছেন। আমাদের পল্লী গায়ক কানাই লাল নীল ও আব্বাস উদ্দিন আমার খুবই প্রিয় শিল্পী। মরহুম আব্বাস উদ্দিন ও আমি যৌথভাবে ফাতেহ লোহানী পরিচালিত ‘আসিয়া’ ছবির সুর সংযোজন করি। এদেশের প্রথম ছায়াছবি ‘মুখ ও মুখোস’ এর সঙ্গীত পরিচালক ছিলাম আমি। তাছাড়া, মাটির পাহাড়, রাজা এলো শহরে, গৌরি এবং ধীরে বহে মেঘনা ছবিতেও আমি সঙ্গীত পরিচালকের দায়িত্ব পালন করি।
১৯৫৪ সালে তৎকালীন ইন্টারন্যাশনাল মিউজিক কনফারেন্সে আমি স্বর্নপদক লাভ করি। ১৯৬৬ সালে আমি ইরানের শাহ্ পদক পাই। ১৯৭৫ সালে পি-আই এ’র উদ্যোগে আয়োজিত কমনওয়েলথ সঙ্গীত সম্মেলনে আমি রাণী এলিজাবেথের প্রশংসা লাভ করি। স্বাধীনতার পদক পাই ১৯৭৯ সালে। আমি চায়না, কোরিয়া, ফিলিপাইন ভ্রমণ করেছি।
আমাদের জাতীয় সঙ্গীত ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি’কে মূলসুর অক্ষুন্ন রেখে সামরিক মার্চ-পাস্ট এর জন্য অর্কেষ্ট্রা তৈরি করি। আমি এফডিসি’র ২৫তম বর্ষপূর্তি উপলক্ষে ট্রফি লাভ করি।
১৯৬১ সাল থেকে ঢাকা রেডিওতে আছি। বর্তমানে আমি চীফ মিউজিক প্রডিউসার। কবি আজিজুর রহমানের লেখা ‘লাজুক লাজুক চোখ মেলেছে সূর্যমূখী ওই’ গানটি প্রথমে ফেরদৌসি রহমানের কন্ঠে তুলি। পরে পাকিস্তানের ইরশাদ জাহানও এই গানটি গেয়েছেন। বাংলা গানে ঠুমরি ও গজলের সুর প্রয়োগ করে সাফল্য পেয়েছি।
১৯৭১ সালের যুদ্ধের সময় আমি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে যোগ দেই এবং ওই সময় বেশ কতগুলো দেশাত্মবোধক গানে সার্থক সুর সৃষ্টি করি। টিভিতে ক্যাজুয়েল আর্টিস্ট হিসাবে কাজ করি।


আমাদের সঙ্গীত জগতের অনেকেই আমরা অগ্রগণ্য। এঁরা হচ্ছেন আবদুল আহাদ, আব্দুল লতিফ, আবদুল হালিম চৌধুরি, শেখ লুৎফর রহমান প্রমুখ।
শিল্পী সমর দাস ক্রীশ্চিয়ান সেন্টার ফর আর্টস কলেজ এবং রীতা সঙ্গীত বিদ্যালয়ের অনারারী প্রিন্সিপাল। তাঁর অনেক ছাত্র-ছাত্রী রয়েছেন। স্ত্রী দীপিকা দাস এবং তিন ছেলে ও এক মেয়ে কম বেশি গান বাজনার সাথে জড়িত। ছোট মেয়ে রেডিওতে ছোটদের আসরে গান গায়।
সমর দাস বললেন, ভবিষ্যতের জন্য দেশ ও দেশের মানুষকে জানতে হবে এবং তাদের জন্য নতুন কিছু সৃষ্টি করতে হবে। নকল করে কিংবা ফাঁকি দিয়ে জীবন চলে না। সঙ্গীত সাধনাও চলে না।
-বাহার আহমেদ
(লেখাটি সংগৃহীত)