শিরোনাম :
প্রবীণদের প্রতি বাড়তি যত্ন
যত্ন নিতে হয় শরীরের। সেইসঙ্গে মনের। কভিড-১৯ আমাদের বুঝিয়ে দিয়ে গেল নিজেদের যত্নের কতটা প্রযোজন। আমরা নিজেরা যেমন ব্যক্তিগত শরীর এবং মনের যত্ন নেব তেমনি পাশেই থাকব পরিবারের। করোনায় শিশু আর প্রবীণদের নিরাপদে রাখার কথা বারবার বলা হয়েছে। বাসার ছোট্ট শিশুটির আদরের কমতি নেই। তেমনি প্রবীণদেরও ক্ষেত্রেও পারিবারিকভাবে নেয়া হয়েছে সচেতনতা। সেটা খাবারদাবারে। স্বাস্থ্যসচেতনতায়। আর পারিবারিক সময় দেওয়ার বিষয়টি তো আছেই।
বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমতে থাকে, দুর্বল হয়ে পড়ে। তাই করোনাভাইরাসের প্রকোপের সময় প্রবীণদের প্রতি বিশেষ মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
বর্তমানে বাড়ির প্রবীণ ব্যক্তি যিনি তার খাবারদাবারে মনোযোগী হতে হবে খুব। বেলায় বেলায় দরকার সচেতনতা। বিভিন্ন বার্ধক্যজনিত জটিলতার কারণে প্রবীণরা নিয়মিত ওষুধ খান। তাদের সেই ওষুধ ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিস মজুদ রাখার বিষয়টি খেয়াল করতে হবে। বাড়ির শিশুদেরকে দায়িত্ব দিয়ে দেওয়া যেতে পারে যেন দাদা-দাদি কিংবা নানা-নানির সঙ্গে মিলে হাত ধোয়ার কাজটা একসঙ্গে করে নেওয়া। খেলতে খেলতে একসঙ্গে হাত ধোয়ার কাজটি করলে প্রবীণ এবং শিশুর মধ্যে মধুর সম্পর্কটি আরো মধুর হবে। তাদের জন্য বরাদ্দ থাকুক আলাদা হ্যান্ড স্যানিটাইজার। ব্যক্তিগত স্যানিটাইজারে জীবাণুমুক্ত থাকবেন তারা।
খাবারদাবারের ক্ষেত্রে এতদিন যেমন খাবার ছিল তাই তারা খেতে পারবেন পরিবারের সবার সঙ্গে মিলে। তারপরও যেহেতু সন্তান কিংবা পরিজন সবাই বাড়িতেই আছেন তাদের খেয়াল রাখতে হবে প্রবীণ জনের খাবারদাবারে।
পরিবারের প্রবীণ সদস্যদের নিয়মিত মেডিকেল চেকআপে এবং অত্যাবশ্যকীয় না হলে ডাক্তার দেখাতে যাওয়া ঠিক হবে না। এ সময় তাদের বাড়ির বাইরে যাওয়াই উচিত নয়। প্রয়োজনে মুদি ও অন্যান্য প্রযোজনীয় সামগ্রী হোম ডেলিভারি নেওয়া উচিত।
সম্প্রতি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক ডা. টেড্রস অ্যাডহানম গেব্রেইয়েসুস বলেছেন, ‘ভাইরাস থেকে প্রবীণদের রক্ষা করতে আমাদের একযোগে কাজ করতে হবে। তারা আমাদের পরিবার ও সমাজের মূল্যবান সদস্য। তারা কভিড-১৯ এ আক্রান্ত হলে গুরুতর অবস্থা হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।’
ডা. টেড্রস আরও বলেন, ‘প্রবীণরা আমাদের সমাজের অভিজ্ঞতার বাহক। তাদের খাদ্য, ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী ওষুধ এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের চাহিদা পূরণ নিশ্চিত করতে হবে।’ শারীরিক দূরত্ব মানে সামাজিক দূরত্ব নয় বলে উল্লেখ করেন তিনি। সামাজিক দূরত্ব বজায় থাকবে। কিন্তু মনের দিক থেকে আমরা কাছাকাছিই থাকব।
ডা. টেড্রস বলেন, ‘আমাদের সকলের উচিত প্রবীণ বাবা-মা, প্রতিবেশী, বন্ধুবান্ধব বা আত্মীয়স্বজন যারা একা থাকেন বা বৃদ্ধাশ্রমে থাকেন তাদের খোঁজখবর নেওয়া। যাতে তারা বুঝতে পারেন তাদের আমরা কতটা ভালোবাসি এবং মূল্যায়ন করি।’
বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের সন্তানেরা প্রবীণ বাবা-মাকে বৃদ্ধাশ্রমে রাখেন না। তারা একসঙ্গেই থাকেন। সুখে-দুঃখে। বটবৃক্ষের ছায়া দেন বাবা-মা। তারপরও কেউ কেউ থাকেন একা। নিঃসঙ্গ। প্রবীণরা এমনিতেই একা। তার ওপর করোনা এসে তাদের একাকিত্ব আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজনের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ঘরবন্দি জীবন কাটছে তাদের।
রুটিন চেকআপে সুস্থ থাকতেন তারা। বর্তমানে এই রুটিন চেকআপ করানোও অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই সমস্যা নিয়ে আলোচনার জন্য ওয়েবিনার আয়োজন করেছিল সিস্টার নিবেদিতা ইউনিভার্সিটির ইন্ডাস্ট্রি কানেক্ট বিভাগ। এতে বক্তব্য রাখেন প্রবীণদের নিয়ে কাজ করেন এমন বিশেষজ্ঞরা। তারা প্রত্যেকেই বলেন, প্রবীণদের ভালো রাখার দায়িত্ব শুধু সন্তানদের নয়, প্রতিবেশী এবং আত্মীয়দেরও।ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিকাল ইনস্টিটিউটের গবেষক সায়নী দাস জানান, প্রবীণদের সমস্যা তিনটি পরিপ্রেক্ষিত থেকে দেখেছেন তিনি। সেই তিনটি পরিপ্রেক্ষিত হলো সামাজিক, শারীরিক ও মানসিক।
গবেষক সায়নী দাস দেখেছেন, সহায়করা না আসায় বাড়ির কাজকর্ম করতে অসুবিধা হচ্ছে তাদের। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনতে বেরোনোর ক্ষমতা নেই অনেকের, অনলাইনেও সক্ষম নন বেশির ভাগই। ফলে বাড়ছে উদ্বেগ, অস্থিরতা। সারাক্ষণ করোনার খবর দেখেশুনে অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ছেন প্রবীণরা।
এমন পরিস্থিতিতে চিকিৎসকদের পরামর্শ হলো স্বাস্থ্যকর খাবার, ঠিক সময়ে ওষুধ খাওয়া আর নিয়মিত ফোনে ডাক্তারের উপদেশ নেওয়া- এভাবেই কিছুটা ভালো থাকতে পারেন বয়স্ক মানুষেরা। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সেবক-সেবিকার খুব প্রয়োজন এই মুহূর্তে। যারা বাবা-মায়ের থেকে দূরে আছেন তাদের ক্ষেত্রে এই সংকটের সময় সরকারের উচিত প্রবীণদের আর্থিক সুরক্ষার বিষয়টি নিশ্চিত করা।
করোনার খবরাখবর থেকে মাঝেমাঝে চোখ সরানোর পরামর্শ দিয়েছেন মনোবিদরা। তার বদলে বরং গান শুনলে, বই পড়লে, শখের কিছু করলে মন ভালো থাকবে। আত্মীয়রা, প্রতিবেশীরা যেন ফোন করে একটু কথা বলেন, ভরসা জোগান। তাহলেই বাড়ির প্রবীণরা অনেকটা ভালো থাকবেন। যখন দূরে থাকি বাবা-মায়ের কাছ থেকে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতে হবে। দেশের বাইরে থাকলে ভিডিও কলে কথা বলে নিন। আপনাকে দেখলেই আপনার বাবা-মায়ের মনের ভার লাঘব হয়ে যাবে অনেকটা। তাই ভিডিওকলে দেখা হোক নিয়মিত।
আর আমরা বাড়িতেই আছি, প্রবীণ বাবা-মায়ের সঙ্গে। হয়তো ব্যস্ততায় সময় দেওয়া হয়নি বাবা-মাকে। এবার সেটা সুদে-আসলে পুষিয়ে নিতে পারেন। বাবা-মায়ের সঙ্গে একত্রে টিভি দেখা। মজার কোনো সিনেমা দেখা। তাদের প্রিয় কোনো রান্না নিজ হাতে করে একসঙ্গে খাওয়া। শৈশব-কৈশোরের মতো একসঙ্গে লুডু-দাবা নিয়ে বসে যাওয়া। মন খারাপের কোনো মেঘ যেন তাদের আশেপাশে ভিড় করতে না পারে। এইটুকু নিয়মিত করলেই দেখবেন প্রবীণ বাবা-মা কেমন ফুরফুরে হয়ে উঠছেন। সেই্সঙ্গে পারিবারিক একটা মিষ্টি সম্পর্ক বিরাজ করবে সবার মধ্যে। সম্পর্কের মিষ্টতা ছড়াক। পরিবারগুলো প্রবীণদের পরশে মিষ্টি হয়ে থাকুক। (সমকাল)