ঢাকা ,
বার : শনিবার
তারিখ : ১৮ মে ২০২৪
বাংলা : ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১
Dcnewsbd Facebook
Dcnewsbd Twitter

শিরোনাম :

সোনাদিঘি

0
923

|| নয়ন যোসেফ গমেজ, সিএসসি ||

গানটি মিলিয়ে যাচ্ছে দূর হতে বহুদূরে। হারুমাঝির গান। একনাগারে অনেকক্ষণ ধরেই গানটি গেয়ে চলছে হারুমাঝি, ‘নাইয়ারে, নায়ের বাদাম তুইল্লা/কোন দেশে যাও চইল্লা…।’ পড়ন্ত বিকেল। শান্ত নদীতে শীতল বাতাস প্রবাহমান। সোনাদিঘি নদী। নদীর বুক চিরে পাখিরা রব তুলে নীড়ে ফিরছে। কানীবক, ইচাবক, গাংচিল, ভুবনচিল, পানকৌড়ি, ডাহুক, বালিহাঁস…। নাম না জানা আরো নানা পদের পাখি। অদূরে কচুরিপানার ভেতর থেকে থেমে থেমে একটি ডাহুক নিরন্তর ডেকেই চলছে। চোখের পলকে বড় সোনালী সূর্যটা পশ্চিমের নদীর জলে তলিয়ে যাচ্ছে। একে একে নদীর বুকে জ¦লে উঠছে জেলে নৌকার হারিকেনগুলো। হারুমাঝির গলা আর শোনা যায় না। কখন যেন মিলিয়ে গেল! সন্ধ্যা নামার সাথে সাথে মাঝিরাও কেমন যেন শান্ত ও নিস্তব্ধ হয়ে যায়। ধূসর প্রকৃতির মত। জ্যোৎস্না রাত্রির মত। মাঝিরা শান্ত হলে নদীর জলে শোনা যায় অশান্ত মাছের গুপ-গুপ শব্দ। সোনাদিঘির মাঝিরা সকলেই জেলে। তবুও পাঁচ গ্রামের লোকমুখে তারা মাঝি হিসেবেই পরিচিত। গ্রামের মানুষ কোন জেলেকে জেলে ব’লে ডাকে না। তেমনি মোহনমাঝি, হারুমাঝি, বিনোদমাঝি, পরানমাঝি এলাকার সকলেরই অতি পরিচিত। অতি আপন। এরা সাধারণ মানুষ। তাই হয়তো একে অপরের অতি আপন।
মোহনমাঝি ডাহুকের ডাক শুনতে শুনতে পুরো জাল জলে নামিয়ে শেষ করে। তারপর অপলক তাকিয়ে থাকে বক ও চিলদের নীড়ে ফেরার দিকে। সন্ধ্যায় পাখিরা নীড়ে পাড়ি দিলেও মোহনমাঝির ঘরে ফেরার জো নেই। রাতের সোনাদিঘিতে ভাল মাছ ধরা পড়ে। দিনের বেলায় মাছ পাওয়া যায় ঠিকই কিন্তু মাছ তখন নদীর মতই চঞ্চল থাকে। রাতে পুরো সোনাদিঘি শান্ত। মোহনমাঝি ভাবতে থাকে ঘরের কথা। ঘরে রয়েছে প্রতিমা। তাতে কি! ঘরের মানুষ ঘরে, নদীর মানুষ জলে। তবুও প্রতিমার কথা মনে হতেই মোহনমাঝির মনটা কেমন যেন মোচড় দিয়ে ওঠে। ঘরে প্রতিমা একা। নদীতে মোহনের সাথে আরো অনেকেই আছে। প্রতিমার সাথে কেউ থাকলে ভাল হত। নির্জন রাত্রিতে একলা ঘরে কারোই ভাল লাগে না। প্রতিমা এতদিনে মা হ’লে ভাল হত। সেটাও হ’ল না! মাঝে মাঝে প্রতিমা রাতে মোহনমাঝির সাথে নৌকায় থাকতে চেয়েছে। মোহন তাতে একবারও সাড়া দেয়নি। দিনের বেলা মাঝে মাঝে বাড়িতে আসে মোহন। তখন প্রতিমা যেন আসমানের পুর্ণিমা চাঁদ হতে পায়। হাতে পায় সোনার হরিণটিকে।
মোহনমাঝি ভাবতে থাকে, নদীর মাঝিদের ঘরের প্রতি এত মায়া ঠিক নয়। তাতে মৎসদেবতা অসন্তুষ্ট হয়। মাঝিদের সমস্ত প্রেম থাকতে হবে সোনাদিঘির সাথে। এই সোনাদিঘিই তো মাঝিদের মুখের অন্নদাত্রী। আজ সোনাদিঘি না থাকলে মাঝিরা কোথায় যে হারিয়ে যেত; কেউ তার খোঁজও তো রাখত না। সোনাদিঘির সাথে মোহনের প্রেম কম হলেও পনের বছরের। শৈশবে বাবার সঙ্গে সোনাদিঘিতে মাছ ধরত মোহন। বাবা না ফেরার দেশে পাড়ি দিয়েছে সাড়ে পাঁচ বছর আগে। মোহন শৈশবে মাকে হারিয়েছে। এরপর বাড়িতে এক পিশি তাদের দেখাশোনা করত। বিধবা নিঃসন্তানা ষাটোর্ধ সন্ধ্যারাণী পিশি। মোহনের বাবার মৃত্যুর পর বছর ঘুরতে না ঘুরতে সেই পিশিটাও মারা যায়। এরপর মোহন প্রতিমাকে ঘরে এনেছে। নদীর বুকে জেলেদের নৌকার আলোগুলো রীতিমত জোনাকির আলোর মত লাগছে। আশে-পাশের প্রতিটি নৌকাতেই হারিকেন জ¦লছে। রাত্রির এই সময়টাতে পুরো সোনাদিঘির জেলেরা সবাই এক হয়ে যায়। একে-একে সকলে একে অন্যের কাছে আসতে থাকে। তারা সকলেই সকলের আপন। তখন তাদেরকে একই পরিবারের সদস্য ব’লেই মনে হয়। নৌকায় মোহনমাঝিকে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে পাশের নৌকা থেকে হারুমাঝি জানতে চায়, ‘কিগো মোহনদা, নায়ে আলো জ¦ালো নাই যে!’ মোহনমাঝির কণ্ঠে অসহায়ত্ব, ‘আরে ভাই, আর কইস্ন্যা! হারিকেনের ত্যালে টান। তাই ইচ্ছা কইরাই জ¦ালি নাই। যদি শ্যাষ হইয়া যায়।’ মোহনমাঝির কথা শুনে হারুমাঝি আরো কাছে ঘেঁষে আসে।
মোহন তাতে সামন্য একটু হাসে। হাসে হারুমাঝিও, ‘এই হইলো মোহনদা, আমার নায়ের আলোয় তোমার নাও আলোকিত হইরো।’ নিজের অসহায়ত্বের মাঝেও এবার জোরে জোরে হাসে মোহন। মানুষ এতাটা গরীব নয় যে সে হাসতে পারে না। গরীব মানুষেরা দু’টি কাজ খুব ভাল পারে; প্রাণখুলে হাসতে ও নিজেকে উজার ক’রে অন্যকে ভালবাসতে। হারু কাছে এলে পর মোহন গল্প জুড়ে দেয়। জীবনের গল্প। চির পরিচিত গল্প। যে গল্প বাস্তবে বিষাদ, নিরাশা, ক্ষুধার জ¦ালা আর অনটন হয়ে নিরন্তর দংশন করে প্রতিদিনকার জীবনকে। হারুমাঝি দু’টি বিড়ি ধরায়। হালকা শীতল বাতাস বইছে। একটি বিড়ি নিজের ঠোঁটে রেখে হারু অন্যটি মোহনমাঝিকে দেয়। মোহন বিড়িটি হাতে নিয়েই মারে এক সুখটান। রাতের এই সময়টাতে বিড়ি বেশ লাগে। গল্প জমে ওঠে। মোহন বেশ গল্পপটু ও আমুদে মানুষ। শত যন্ত্রণার মাঝেও তার এই রূপ বদলায় না। মোহন বলতে থাকে, ‘বুঝলিরে হারু, প্রতিদিন জীবনকে প্রসব করা-ই জীবন। শুধু যোগ-বিয়োগের খেলাই জীবন। সুখে-দুঃখে, ধনে-দারিদ্রে বারংবার মরতে-মরতে বেঁচে যাওয়া-ই জীবন। হায়রে জীবন…!’ হারুমাঝি মগ্ন হয়ে শুনে মোহনমাঝির গল্প। মোহনের কথায় কেমন যেন একটা জাদু আছে। ওর প্রতিটি কথাই কর্ণ-গহ্বর দিয়ে একেবারে অন্তর গহীনে নেমে যায়। জেলে নৌকায় আলোতে সোনাদিঘির জল চিক-চিক করছে। জেলেরা কেউ কেউ রাতের খাবার খেতে কদমতলী বাজারে গেছে। সোনাদিঘির ওপারেই কদমতলী বাজার। মোহন আর হারুমাঝি সন্ধ্যার আগেই বাজার হতে খেয়ে নিয়েছে। রাতের বেলা সোনাদিঘি ছেড়ে বাজারে যেতে তাদের তেমন একটা ভাল লাগে না। যার সাথে যার দিন-রাত্রির প্রেম; তাকে ছেড়ে তার ভাল লাগবেই বা কেন? মোহন আর হারু একদিন না খেয়ে থাকতে পারে কিন্তু একদিন সোনাদিঘিতে না এসে থাকতে পারে না। সোনাদিঘির জলে ছন্দের মাতন। ছল-ছল, টল-মল, ছলাৎ-ছলাৎ। রাত যতই গভীর হয় ছন্দ ততই মধুর লাগে। হারুমাঝি এতক্ষণ কোন কথা বলেনি। চুপচাপ শুনছিল মোহনের কথা। এবার হারু কথা না ব’লে আর পারে না। হারুর হারিকেনের আলোয় স্পষ্ট ধরা পড়ে মোহনমাঝির অশ্রুসিক্ত চোখযুগল। হারু গম্ভীর হয়ে ওঠে, ‘আরে! আরে!! আরে, ঐ মোহনদা, আথ্কা কি হইল গো তোমার? তুমি দেহি কান্তাছো গো…।’ মোহন কোন কথা বলে না। হাতের বিড়িটা এক নিঃশ^াসে টান দেয়। তারপর বিড়ির শেষ প্রান্তটুকু ফেলে দেয় সোনাদিঘিতে। হঠাৎ গান ধরে মোহনমাঝি, ‘আমি হই নাই তোমার মনের মত/ দিলে অকূলে ভাসাইয়া, কাঙাল বলিয়া/ বোবায় যেমন স্বপ্নে দ্যাখে, মনের স্বপ্ন মনে থাকে রে/ ওসে কিছু নাহি বলতে পারে/ হৃদয় যায় ফাটিয়া, কাঙাল বলিয়া/ বন পুইড়া যায় সবাই দ্যাখে, ওরে মনের আগুন কেউনা দ্যাখে রে/ও তার মনের আগুন মনে থাকে…।’
নদীর কূল ঘেঁষা এই গ্রামটির নাম মারাম্বলপুর। গ্রামের একবারে শেষ মাথায় মোহন মাঝির ঘর। গ্রামে ঢুকতেই সম্ভ্রান্ত লোকের বসতি। গ্রামের মানুষের মুখে এর নাম মহাজনপাড়া। মহাজনপাড়ার পর ছোট্ট একটা বিল। বিলের পরেই মাঝিপাড়া। এই মাঝি পাড়াতেই মোহন ও হারুমাঝিদের বাড়ি। মাঝিরা দিনের বেলায় অল্প সময়ের জন্য বাড়ি আসলেও তাদের রাত্রি কাটে সোনাদিঘিতে। সোনাদিঘিতে সারা বছরই থাকে মোহন। মাছ ধরার পাশাপাশি দিনের একটা সময় খেয়া পাড়াপাড়ের কাজও করে। তাতে একটু উপরি আয় হয়। খেয়া পাড়াপাড়ের জন্য ফৈলজানা ইউনিয়ন পরিষদ থেকে মাসিক তিনশত টাকা বেতন পায় মোহন। সেই টাকা জমিয়ে দেড় মাস আগে প্রতিমাকে কয়েকটি হাঁস-মুরগি ও ছাগল কিনে দিয়েছে মোহন। বাড়িতে প্রতিমা সেগুলো নিয়েই দিন পাড় করে। মাঝে মাঝে মহাজনপাড়ার কোন বৌঝিদের কাছ থেকে ঘর-দোর ও গৃহস্থালী কাজের ডাক পড়লে প্রতিমা সেখানে যায়। মাঝি বৌদের মধ্যে প্রতিমা বেশ পটু সবকিছুতে। ব্যহহারও বেশ নজরকাড়া। তাই মহাজনপাড়ার বৌরা ওকে জবর পছন্দ করে। মাঝে মধ্যে মহাজনপাড়ার অনেক মহাজানও প্রতিমাকে টাকার লোভ দেখায়। প্রতিমা সেদিকে ফিরেও তাকায় না। মোহনমাঝির বৌ প্রতিমা মোহনের লক্ষ্মী-প্রতিমা; সোনার প্রতিমা। অভাবী হলেও মোহনের ঘরে ওর সুখের কমতি নেই। মোহন প্রতিমার পতিদেব। আর প্রতিমার কাছে পতিগৃহ মাত্রই স্বর্গ।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে নামে রাত্রির নিদারুণ নিস্তব্ধতা। মারাম্বলপুর গ্রামের মানুষ ঘুমাচ্ছন্ন। প্রতিমা এখনো ঘুমায়নি। গ্রামের নেড়ী কুত্তাগুলো একনাগারে ডাকেই চলেছে। বাঁশঝাড়ের নিচে শেয়ালের আহাজারি। তালগাছে লক্ষ্মীপ্যাঁচা দম্পতির বিলাপ। হঠাৎ ভেসে আসে দুধের শিশুর কান্না। বুড়ো মানুষের গলাধরা কাশির আওয়াজ। প্রতিমার চোখে ঘুম-ঘুম ভাব। আকাশে পুর্ণিমা চাঁদ। উঠানে কুকুরটি অসম্ভব ঘেউ ঘেউ করছে। হয়তো শেয়াল-বাড়াল ঘুর ঘুর করছে মুরগির ঘরের দিকটায়। প্রতিমা বিছানা ছেড়ে বাইরে এসে দাঁড়ায়। বাঘাকে ডাক দেয়। বাঘা তাদের কুকুরটির নাম। পরিচিত মানুষের কথা শুনে বাঘা কাছে ঘেঁষে লেজ নাড়ছে। হঠাৎ দু’টো শেয়াল উঠানের বড়ই গাছটির নিচ দিয়ে ছুটে পালায় সোজা বিলের দিকে। বাঘা হুঁ-হুঁ করে তেড়ে যায় ওদিকটায়। প্রতিমাদের উঠানের ওপাশে লাউয়ের মাচান। এরপরই পরানমাঝির ঘর। হঠাৎ পরানমাঝির ঘরে দরোজা খোলার আওয়াজ পাওয়া যায়। প্রতিমা তাকায় ওদিকটায়। বিকালে পরানের বউ যে লোকটির সাথে তালতলায় কথা বলেছিল, সেই লোকটি বারান্দা থেকে উঠানে নামে। তারপর কোনদিকে না তাকিয়ে বাঁশঝাড়ের নিচ দিয়ে খরগোশের মত সোজা পা বাড়ায় মহাজন পাড়ার দিকে। খরগোশ যখন ভীত-সন্ত্রস্ত থাকে তখন সে কোন একটা পরিষ্কার জায়গায় বসে নিজের চোখ বন্ধ ক’রে ভাবে তাকে হয়তো আর কেউ দেখছে না। তালগাছের মাথায় প্যাঁচা-দম্পতি পাখা ঝাঁপটায়।
প্রতিমা বিছানায় ফিরে আসে। রাত্রির প্রথম প্রহর। অদূরের রাস্তা থেকে ভেসে আসছে বিনোদমাঝির বিচ্ছেদী গান, “প্রেম কইরা মইলাম গো সাঁই বিচ্ছেদ জ¦ালায়/ ঘাটে ঘাটে আমার বন্ধু কুদরতে খেলায়/ হায়রে ঘাটে ঘাটে আমার বন্ধু কুদরতে খেলায়/ প্রেম মেলে না হেসে ঘেঁষে, প্রেম মেলে না ভালবেসে/ প্রেম মেলে না উপবাসে সাধনায়…।” প্রতিমা তন্ময় হয়ে শুনতে থাকে বিনোদের গানের কথাগুলো। বিনোদমাঝির কোন হিসাব নিকাশ নাই। সে সোনাদিঘিকে যেমন ভালবাসে তেমনি ভালবাসে নিজের কুঁড়ে ঘরটিকে। বিনোদমাঝির ঘর আছে বটে কিন্তু ঘরের সৌন্দর্য নাই। চাটমোহরের হারান পালের মেয়ে ললিতাকে বিয়ে করেছিল সে। ললিতা বেশ শান্ত-শিষ্ট স্বভাবী মেয়ে ছিল। তবে বিনোদের ঘরে বছর ঘুরতে না ঘুরতেই ললিতা চলে গেল দূরে বহুদূরে। সেখান থেকে আর ফেরেনি সে। হয়তো আর ফিরবেও না কোনদিন। বিনোদের সাথে ব্যবসায়ীগোছের এক ভদ্রলোকের বেশ ভাব ছিল। কোন একসময় বিনোদ সেই লোকটির কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা ধার এনেছিল।
এরপর থেকে লোকটি প্রায়ই আসতো বিনোদের বাড়িতে। বিনোদ তাতে কিছুই মনে করত না। পরিচিত মানুষ। বাড়িতে আসতেই পারে। ঘর-দোরে বসতেই পারে। লোকটি বাড়িতে এলে ললিতা কখনোই লোকটির সাথে কথা বলতো না। কাছে আসতো না। ঘর থেকে বেড় হত না। এই নিয়ে বিনোদ ললিতার সাথে কথা কাটাকাটিও করেছে বেশ কয়েকবার! ললিতা নাকি মানুষকে সমাদর করতে জানে না! ললিতা নাকি পতিদেবের মঙ্গল চায় না…! মোহনমাঝির ঘরের কাছাকাছি আসতেই বিনোদ পরিচিত মায়াবী কন্ঠে প্রতিমাকে ডাক দেয়, ‘বৌদি, ও বৌদি, ও প্রতিমা বৌদি, ঘুমায় গেছো নি। শোন, মোহনদা কইলাম কাইলকে বাড়িতে আইতে পারে। আর আমি, আমি কিন্তু দুপুরে তোমাদের এখানে খামু।’ প্রতিমা কোন সাড়া না দিয়ে নীরবে শোনে বিনোদের কথা। প্রতিমা ও মোহনের সাথে বিনোদের সম্পর্ক বেশ ঘনিষ্ঠ। পরিবারের না হয়েও যেন পরিবারের। বিনোদ মোহনকে আপন বড় ভাইয়ের মত সম্মান করে। মোহন বাড়ি থাকলে সাড়াদিন পড়ে থাকে মোহনের সাথে। মাঝে মাঝে খাওয়া-দাওয়া করে। টুকটাক ফুট-ফরমাশ করে। প্রতিমা বিনোদকে ভাইডি বলে ডাকে। ললিতা পলিয়ে যাবার পর বিনোদ নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে দিয়ে কয়েকদিন পাগলের মত পড়ে ছিল মোহনের বাহির-বাড়ির মাচনের উপর । শেষে অনেক বলে-কইয়ে প্রতিমা ওকে দু’মুঠো ভাত খাইয়েছিল।
দুপুরের একটু আগেই মোহনমাঝি বাড়িতে আসে। প্রতিমা রান্না-বান্নায় ব্যস্ত। বিনোদও এসেছে। মোহন ও বিনোদ মাচানে বসে গল্প করছে। দুপুর গড়িয়ে গেছে। আচম্কা পুরো আকাশ জুড়ে দেখা দেয় ঘন কালো মেঘ। দুপুরে খাবার পর মোহন একটু ঘুমিয়ে নেয়। শেষ বিকাল। আকাশে মেঘ করলেও বৃষ্টি হয়নি। পশ্চিমাকাশে ক্ষীণ রক্তিম সূর্যটা তখনো ডোবেনি। প্রতিমা উঠানে মরগিগুলোকে খাবার দিচ্ছে। কাছে আসে মোহন, ‘বউ, শোন একটা কথা…!’ মোহনের কথা শুনে রীতিমত আনন্দে উদ্বেলিত হয় প্রতিমা, ‘কি কথা! কও মাঝি। মনে হইতাছে যেন শরম পাইতাছো! ’ মোহন প্রতিমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলতে থাকে, ‘তুমি না একদিন সোনাদিঘিতে যাইতে চাইছিলা।’ প্রতিমা হেসে ব’লে, ‘একদিন মানে, আমি তো প্রায়ই তোমার লগে সোনাদিঘিতে যাইতে চাই। তুমিতো আমারে একদিনও নিলা না।’ মোহনও হাসে প্রতিমার কথা শুনে, ‘বউ, আইজ যাইবা তুমি আমার লগে, সোনাদিঘিতে? জানো, আমার সোনাদিঘি তোমারে দেখবার চাইছে।’ এবার প্রতিমা কোন কথা বলে না। কেবল মুচকি হাসে।
সন্ধ্যার সোনাদিঘি। মিটি-মিটি জ¦লছে জেলে নৌকার আলোগুলো। এ যেন নদীর বুকে তারার মেলা। মোহন হারিকেনটা নিভু-নিভু ক’রে ছইয়ের উপর ঝুলিয়ে রেখেছে। হারু, বিনোদ, পরান তখন সোনাদিঘিতে জাল ফেলায় ব্যস্ত। ওরা জাল ফেলতে ফেলতে অনেকটা দূরে চলে গেছে। কচুরিপানার নিচে ডাহুক ডাকছে। প্রতিমা নৌকার ছইয়ের মুখে বসা। মোহন নৌকা বাইছে। সোনাদিঘির জল ছল-ছল করছে। জেলে নৌকার আলোয় জল হীরক খন্ডের মত চিক-চিক করছে। প্রতিমা মুগ্ধ হয়ে দেখছে সেসব; আর গল্প করছে তার মোহন মাঝির সাথে। স্মৃতিপটের গল্প, অনাগত দিনের গল্প। ‘মাঝি, দেখো তোমর সোনাদিঘির জল কেমন চঞ্চল হইয়া উঠছে। হয়তো রাইত গভীর হইছে বইলা। মাঝি, আইজ সোনাদিঘিতে তোমার জাল নামাইবা না।’ মোহন তাকায় প্রতিমার দিকে। প্রতিমা হাসে। হাসে মোহনও। আজ তার প্রতিমাকে কেমন যেন নতুন লাগছে মোহনের কাছে। মোহন তা মুখে বলতে চেয়েও পারল না। প্রতিমা আলতো ক’রে ডাক দেয় মোহনকে, ‘ও মাঝি!’ বইঠা রেখে কাছে আসে মোহন। প্রতিমার একবারে কাছে। মোহন বড্ড আশ্চর্য হয়! হঠাৎ তার ভেতরটা ভরে ওঠে অপরিচিত অনুশোচনায়। দু’চোখ ফেঁটে কেন জানি অশ্রুধারা বইতে চাইছে। তবে তা বুঝতে দেয়নি প্রতিমাকে। মোহন প্রতিমার হাতে হাত রাখে, ‘হ বউ, সত্যিই তো আমার সোনাদিঘি জবর চঞ্চল হইয়া উঠছে। আইজ রাইতে আমার সোনাদিঘিরে কেমুন যেন নতুন লাগতাছে। সোনাদিঘি, আমার প্রাণের সোনাদিঘি…।’

লেখক: সন্ন্যাসব্রতধারী, পবিত্র ক্রুশ যাজক সংঘ, রামপুরা, ঢাকা।