শিরোনাম :
মনিপুরে মানবিক বিপর্যয়, চারমাস ধরে চলমান নারকীয় ধ্বংসযজ্ঞ, বাংলাদেশের খ্রিষ্টান নেতৃবৃন্দের তীব্র নিন্দা প্রকাশ
ডিসিনিউজ।। ডেস্ক
ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের অপেক্ষাকৃত ছোট রাজ্য মণিপুরে স্থানীয় কুকি আদিবাসীদের সঙ্গে সংখ্যাগরিষ্ঠ মেইতেই সম্প্রদায়ের চলছে জাতিগত বিরোধ। জমি ও প্রভাব-প্রতিপত্তি নিয়ে এই বিরোধ সহিংসতায় রুপ নেওয়ায় অনেকেই চলমান অবস্থাকে গৃহযুদ্ধের সাথে তুলনা করেছেন।
গত মে মাসে কুকি সম্প্রদায়ের গ্রামে আক্রমণ করে ঘরবারি ধ্বংস করে মেইতেই স¤প্রদায়ের লোকেরা। একইসাথে কুকি স¤প্রদায়ের নারীদের ওপর নির্যাতনও চালানো হয়। এমন সব অভিযোগের মাঝেই চলতি সপ্তাহে ঐ সহিংসতা সম্পর্কিত একটি চাঞ্চল্যকর ভিডিও প্রকাশিত হয়েছে। ভিডিওতে দেখা যায়, একটি গ্রাম আক্রমণের পর পরিবারের সদস্যদের হত্যা করে দুই নারীকে বিবস্ত্র অবস্থায় হাঁটতে বাধ্য করছে মেইতেই সম্প্রদায়ের কিছু পুরুষ।
মণিপুর বাংলাদেশের পূর্বে ও মায়ানমার সীমান্তে অবস্থিত ভারতের এক পাহাড়ি রাজ্য। এতে প্রায় ৩৩ লাখ মানুষের ২২বসবাস। এই জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেকেরও বেশি মেইতেই সম্প্রদায়ের । আর রাজ্যটিতে প্রধান সংখ্যালঘু আদিবাসী হিসেবে কুকি ও নাগা সম্প্রদায়ের মানুষ শতকরা ৪৩ ভাগ।
রাজ্যটিতে মে মাসে শুরু হওয়া সহিংসতায় এখন পর্যন্ত প্রায় ১৩০ জন মানুষ নিহত ও ৪০০ জন মানুষ আহত হয়েছে। অবস্থা এতটাই নাগালের বাইরে চলে গিয়েছে যে, সেনাবাহিনী, আধাসামরিক বাহিনী ও পুলিশ সহিংসতা দমন করতে হিমশিম খাচ্ছে। প্রায় ৬০ হাজার মানুষ নিজেদের ঘরছাড়া হয়েছে। পুলিশের অস্ত্রাগার লুট করা হয়েছে। শত শত চার্চ, কয়েক ডজন মন্দির ধ্বংস করা হয়েছে। বহু গ্রামে চালানো হয়েছে হামলা।
মুলত সংখাগরিষ্ঠ মেইতেই সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি লাভের দাবির মধ্যে দিয়ে ঘটনার সুত্রপাত ঘটে। এতে করে তারা কোটাসহ বেশ কিছু বাড়তি সুবিধা লাভ করবে। অন্যদিকে মেইতেই সম্প্রদায়ের এ দাবির জোরালো বিরোধিতা করছে কুকি সম্প্রদায়। কুকি সম্প্রদায়ের যুক্তি হচ্ছে, ইতোমধ্যে রাজ্যটির সরকারে ও সমাজে একচেটিয়া প্রভাব বিস্তার করেছে মেইতেই সম্প্রদায়। এমতবস্থায় তাদেরকে আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি দিলে তারা আরও বেশি শক্ত অবস্থান তৈরি করবে। এমনকি তখন সংখালঘু কুকি সম্প্রদায়ের এলাকার মেইতেই সম্প্রদায়ের লোকেরা জমি কিনতে পারবেন কিংবা বসতি স্থাপন করতে পারবেন।
কিন্তু এসব শঙ্কা ছাড়াও সহিংসতার পেছনে আরও অগণিত অন্তর্নিহিত কারণ রয়েছে বলে অনুমান করা হচ্ছে। কুকি সম্প্রদায়ের অভিযোগ, মেইতেই সম্প্রদায়ের নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার নামে আড়ালে কুকি সম্প্রদায়কে দমনের চেষ্টা করছে।
অন্যদিকে মিয়ানমার থেকে অবৈধ অনুপ্রবেশ মণিপুর রাজ্যের উত্তেজনা যেন আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে ভূমি ব্যবহারের উপরও চাপ সৃষ্টি হয়েছে। যার ফলে সৃষ্টি হচ্ছে বেকারত্ব। আর এই বেকারত্বের কারণে যুবকদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ মিলিশিয়া বাহিনীতে যোগ দিচ্ছে।
রাজ্যটিতে মেইতেই, কুকি ও নাগা সম্প্রদায়ের আলাদা আলাদা মিলিশিয়া বাহিনী গড়ে উঠেছে। বাহিনীগুলো ধর্মভিত্তিক ভিন্নতা ও মাতৃভূমির দাবিতে একে অপরের সাথে যুদ্ধ করছে। এমনকি এই তিন গোষ্ঠীর প্রত্যেকেই আবার ভারতের নিরাপত্তা বাহিনীর সাথে সংঘাতে জড়িয়েছে।
মেইতেই সম্প্রদায় মণিপুর, মিয়ানমার ও আশেপাশের অঞ্চলে বসবাস করেন। এদের বেশিরভাগই হিন্দু। অন্যদিকে কুকি সম্প্রদায়ের বসবাস উত্তর-পূর্ব ভারতজুড়ে। মণিপুরে বাস করা এ সম্প্রদায়ের অনেকেরই আবার নিজেদের মিয়ানমারের অধিবাসী বলে মনে করেন। কুকি জনগোষ্ঠীর বেশিরভাগই খ্রিষ্টান ধর্মের অনুসারী। মেইতেই সম্প্রদায়ের মানুষেরা বেশিরভাগই রাজ্যটির মূল শহর ইম্ফল উপত্যকায় বসবাস করে। অন্যদিকে কুকি সম্প্রদায়ের বসবাস আশেপাশের পাহাড়ি অঞ্চলগুলোতে।
দীর্ঘ চারমাসের বেশি সময় ধরে চলমান ভারতের উত্তর-পূর্বঞ্চালীয় রাজ্য মনিপুরে অব্যাহত জাতিগত দাঙ্গায় প্রাণহানি, ঘরবাড়ি, গির্জা, মন্দির আক্রান্ত হওয়ার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ খ্রীষ্টান এসোসিয়েশন। এসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট নির্মল রোজারিও এবং মহাসচিব হেমন্ত আই কোড়াইয়া এক যুক্ত বিবৃতিতে এই উদ্বেগ প্রকাশ করে ঘটনার প্রতিবাদ, নিন্দা এবং ধিক্কার জানিয়েছেন।
তাঁরা বলেছেন, এই ঘটনা ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও মূল্যবোধের সাথে কোনভাবেই যায় না। এই যুগে ধর্মীয় ও জাতিগত সংঘাত নিতান্তই বেমানান। আবিলম্বে এ ধরণের ন্যাক্কারজনক, অমানবিক এবং হিংসাশ্রয়ী কার্যকলাপ বন্ধের আহবান জানাচ্ছি আমরা। ভারত সরকারকে নিরপেক্ষ ও কার্যকর পদক্ষেপ নিয়ে, জাতি-গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে সহবস্থান ও আস্থা সৃষ্টিতে বিশেষ ভ‚মিকা রাখার আহ্বান জানাচ্ছি। একই সাথে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি, পরিবার, সংস্থা ও সংগঠনগুলোকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ প্রদানেরও অনুরোধ জানাচ্ছি।
অপর দিকে মনিপুরের ঘটনায় বাংলাদেশ খ্রীষ্টান এসোসিয়েশন মানববন্ধ করারও প্রস্তুতি নিচ্ছে।