শিরোনাম :
লড়াই
সুমন কোড়াইয়া
কাজলের মনে পড়ে যায় ছোটবেলার কথা। সে তনার বাড়িতে মরিনাদের বাড়িতে মুরগি নিয়ে যেতো। কারণ তাদের বাড়িতে মোরগ ছিলো না। মুরগির প্রজননের জন্য তাই মুরগের কাছে মুরগি নিয়ে যেতো।
দড়ি দিয়ে মুরগির পা বাঁধা থাকতো। সেটা মোড়গের কাছে ছেড়ে দিতে হতো। সেই বয়সে একটি জিনিস দেখতে তার খুব ভালো লাগতো। মোড়গের লড়াই। গলা ফুলিয়ে দুই মোড়ক লাফিয়ে লাফিয়ে লড়াই করতো। সেটা দেখার জন্য তার বয়সী আরো অনেকে জড়ো হতো। শেষে অবশ্য পরাজিত মোড়কের জন্য মায়া হতো।
হঠাৎ তার ইন্টাভিউর জন্য ডাক এলো। সেও পড়াশোনা শেষ করে জীবনযুদ্ধে নেমেছে, ভালো একটা চাকরির জন্য লড়াই করছে। এটা তার ৬ষ্ঠ চাকরির ইন্টারভিউ। এর আগে যতবারই সে পরীক্ষা দিয়েছে তার ইংরেজি জ্ঞান ভালো না থাকায় চাকরিটা হয়নি। সব উত্তর ঠিক মতো দিতে পারলেও বাংলা থেকে ইংরেজি বা ইংরেজি থেকে বাংলা অনুবাদ করতে গেলে তার সব কিছু উলট পালট হয়ে যায়। সে মাস্টার্স পাস করেছে। টিউশনি পড়ায়। তারপরও চাকরিতে যে ইংরেজি দিয়ে উত্তর চায়, সে সেটা ভালোভাবে দিতে পারে না।
একটি অফিসের এক্সিকিউটিভ অফিসার পদের জন্য দেড় ঘন্টা পরীক্ষা পর বের হয়ে এলো। কাজলের নিজেকে খুব অপরাধী মনে হচ্ছে। অযোগ্য মনে হচ্ছে। বার বার নিজেকে গালি দিতে মনে হচ্ছে। দেওয়ালে মাথা ঠুকতে মনে হচ্ছে। মাথা ঠুকে রক্ত বের করে ফেলতে ইচ্ছে হচ্ছে!
মতিঝিলের বাসস্টন্ডের সামনে এসে সে দাঁড়ালো। বাসে উঠতে পারে। কিন্তু এই চৈত্র মাসের গরমে আর যানজটের কারণে বাসে উঠতে ইচ্ছে হচ্ছে না। আপন মনে ফুটপাত দিয়ে সে হেঁটে প্রেস ক্লাবের দিকে রওনা দেয়।
হঠাৎ মোবাইলটা বেজে উঠলো।
স্যার কখন আসবেন?
আজ সন্ধ্যা সাতটায় আসবো।
স্যার একটু আগে আসা যায় না? সাতটার দিকে এক জায়গায় নিমন্ত্রণ খেতে যাবো।
ঠিক আছে পৌনে ছয়টায় আসবো।
আসবেন কিন্তু স্যার। ফোনটা রেখে দেয় কাজল রোজারিও। সে মোট ৫টা টিউশনি করে। মেসে থেকে নিজে কোন রকম চলতে পারে। এছাড়া উত্তরবঙ্গে বিধবা মার জন্য প্রতিবাসে কিছু টাকা পাঠাতে হয়। মায়ের একমাত্র ছেলে সে। মার বড় আশা, ছেলে ভালো চাকরি পাবে। তার সংসারের অভাব ঘুচাবে।
আবার ফোনটা বেজে উঠে। মিথিলার ফোন।
পর পর তিন বার বাজার পর সে ফোনটা ধরলো।
এত দেরি হলো কেন ফোন রিসিভ করতে? কন্ঠে অভিমান ঝড়ে পড়লো।
আমি রাস্তায়।
ও। কোথায় গিয়েছিলো? ইন্টারভিউ দিতে?
হু। কিন্তু মনে হচ্ছে কোন লাভ হবে না।
হবে হবে। ধৈর্য ধর।
জানি না কী হবে। ঢাকা শহরে লক্ষ লক্ষ যুবক বেকার। চাকরির বাজার এত সহজ না। ঠিক আছে ফোনটা রাখ বাসায় গিয়ে কথা বলবো।
মিথিলা বললো, জরুরি কথা আছে। দেখা করতে হবে।
আজ পারবো না। আমার এখনো ৪টা টিউশনি বাকি আছে। দেখা করলে সন্ধ্যা ছয়টার পর।
ঠিক আছে- বলে ফোনটা রেখে দেয় মিথিলা।
সন্ধ্যা সাতটায় টিউশনি শেষ করে একটি রেস্টুরেন্টে গিয়ে বসলো কাজল। মিথিলা গমেজ এখনো আসছে না। আনমনে ভাবতে থাকে তাদের প্রেম হয়ে যাওয়ার কথা।
একই সাথে পড়তো তারা। ভালো বন্ধু ছিলো। কিন্তু কখনোই কেউ কাউকে বুঝতে দেয়নি যে পরস্পর পরস্পরের ভালো লাগে। বন্ধুরা অনেক বার বলেছে, তোদের মধ্যে কোন প্রেম টেমের সম্পর্ক হয়েছে? তারা অস্বীকার করেছে।
কাজল বলেছে, আমি তো কখনো ওকে বলিনি আমি তাকে ভালোবসি!
মিথিলা তার বান্ধবীদের বলেছে, দুর! কাজলের সাথে প্রেম করতে যাবো কেন? সে তো আমার বন্ধু!
কিন্তু এই দুজনকে প্রায়ই সন্ধ্যায় দেখা যায় টিএসসিতে এক সাথে কফি খেতে। আড্ডা মারতে।
বসে বসে কাজল ভাবছে, কি বলবে মিথিলা? মিথিলা কি কোন সমস্যায় পড়েছে?
এক গুচ্ছ লাল গোলাপ নিয়ে সাথে একটি উপহারের প্যাকেট নিয়ে হাসি মুখে উপস্থিত হয় মিথিলা। পরনে লাল শাড়ি। লাল টিপ। ওকে এই সাজে খুব ভালো লাগে কাজলের।
কাজল কিছু বোঝার আগেই মিথিলা বলে উঠলো, ‘শুভ জন্মদিন কাজল’ বলেই পুষ্পগুচ্ছ এবং উপহারের প্যাকেটটি এগিয়ে দিলো।
ধন্যবাদ দিয়ে তা গ্রহণ করলো কাজল। তুমি কীভাবে জানলে আমার জন্ম দিন?
বারে জানবো না।
দুজনের জন্য খাবার অর্ডায় দেয় কাজল। তারপর বল তোমার বিয়েসাদির খবর কি?
বিয়েসাদির খবর মানে। তোমার তো এখনো চাকরিই হয়নি? অবশ্য আমার চাকরি দিয়ে দু’জনে মোটামুটি চলতে পারবো। কিন্তু আমি চাই তুমি আগে চাকরি পাও তারপর বিয়ে করবো।
লজ্জায় লাল হয়ে যায় কাজল। লাজুক কাজলের ডান হাত ধরে বলে, এত লজ্জার কিছু নাই। আমি জানি, আর তুমিও জান আমরা পরস্পরকে ভালোবাসি।
নীরব থাকে কাজল।
এক ঘন্টা গল্প করে রিক্সায় চেপে বাসায় পৌঁছে দেয় মিথিলাকে।
৭ম বারের মতো ইন্টারভিউ বোর্ডের মুখোমুখি কাজল। আপনার তো কোথাও চাকরির অভিজ্ঞতা নাই! কিভাবে করবেন এই কাজ?
স্যার, আপনারা শিখিয়ে দিলে সেভাবে করবো?
কিন্তু আমাদের তো অভিজ্ঞ লোক দরকার। এখানে যারা ইন্টারভিউ দিতে এসেছে তারা সবাই অভিজ্ঞ, শুধু আপনার লিখিত পরীক্ষা তাদের চেয়ে ভালো হয়েছে। তবে আপনি ইংরেজিতে কাঁচা।
মাথা নেড়ে নিজের দুর্বলতার কথা স্বীকার করলে কাজল।
গুড। নিজের দুর্বলতার কথা শিকার করা ভালো। আর সেটা ওভারকাম করার চেষ্টাও থাকা চাই।
আমার সেটা আছে স্যার- দৃঢ় কণ্ঠে বলে কাজল।
ঠিক আছে আমরা ভাববো। এখানে ৫০ জন পরীক্ষা দিয়েছে। তারমধ্যে থেকে তিনজন নেওয়া হবে। আপনি আসতে পারেন।
আবারও হতাশ কন্ঠে ইন্টারভিউর কক্ষ থেকে প্রস্তান কাজলের। সে জানে, চাকরি এত সহজ না। রাস্তার মোড়ে গিয়ে একটা সিগারেট ধরায়। লম্বা টান দিয়ে আকাশের দিকে ধোঁয়া ছাড়ে।
পর পর দুইটা ইন্টারভিউ দিয়েছে। এক মাস হয়ে গেল কোন খবর নাই। রাতে মাকে ফোন দিলেই জিজ্ঞেস করে, বাবা চাকরির কোনো খবর হলো?
মাকে উদাস গলায় বলে, না মা। আমার জন্য দোয়া করো।
আমি তো দোয়া করি বাবা! দেখিস তোর বড় চাকরি হবে।
মার কথায় আশা ফিরে পায় কাজল।
বাইরে কে যেন কড়া নাড়ছে। মা ফোনটা রাখ। বাসায় কে যেন এসেছে। বলে রেখে দেয় ফোনটা।
দরজা খোলে অবাক হয়ে যায় কাজল। মিথিলা! তুমি!
হ্যাঁ আমি! কেন আমাকে আশা করনি।
না সেটা না। তোমাকে ভেতরে আনতে পারবো না। একটু দাঁড়াও।
ঠিক আছে। ছেলেদের মেস হওয়ায় ভেতরে মেয়ে গেস্ট এলাও না। যদিও মিথিলা তার হবু স্ত্রী তবুও সে নিয়ম ভাঙ্গতে চায় না।
দুই মিনিটের মধ্যে কাপড় পরে বের হয় কাজল।
তারা কাছেই একটা খাবারের দোকানে গিয়ে বসে।
আমার বড় মামা আমার বিয়ের জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। মা মারা যাওয়ার পর এই মামাই আমাকে পড়ার জন্য খরচ দিয়েছে। তাকে কীভাবে আটকাবো বুঝতে পারছি না।
ছেলে কী করে?
বিদেশে থাকে। এবার দেশে এসে বিয়ে করবে। দুই-এক বছর পর বৌ নিয়ে আমেরিকায় চলে যাবে।
চুপ থাকে কাজল।
কিছু একটা বল!
কী বলবো! দীর্ঘ শ্বাস ছাড়ে কাজল।
অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে থাকে দুজন।
কাজল ভাবে, আমি হেরে যাচ্ছি। আমার সামনে দিয়ে আমার প্রিয়তমাকে অন্যরা নিয়ে চলে যাচ্ছে আমার করার কিছুই নাই! আমি যুদ্ধে হেরে যাচ্ছি।
কাজল!
মিথিলার ডাকে স্বস্বিত ফিরে পায় কাজল।
কাজল বলে, আমি আপাতত একটা কিন্ডারগার্ডেন জয়েন করি। সেখানে হয়ত বেতন বেশি দিবে না, কিন্তু বেকারত্বের দায়টা তো মিটবে!
আমিও তোমাকে সেই কথাই বলতাম। অফিসের চাকরির জন্য বসে থেকে লাভ নেই।
ফেরার পথে ফার্মগেট একটা কিন্ডারগার্ডেন স্কুলে যায়। সেখানকার প্রধান শিক্ষক বলেন, আমাদের টিচার দরকার। তবে বেতন আড়াই হাজার টাকা।
সেটাতেই রাজি হয় কাজল। দিনে ছয় ঘন্টা পড়াতে হবে। বাকি সময়ে সে টিউশনি করবে।
শুরু হয় কাজলের নতুন সংগ্রামী জীবন। সকাল সাড়ে সাতটা থেকে স্কুলে ডিউটি শুরু। দুপুরে মেসে যায়। সেখানে খাবার খেয়ে যেতে হয় টিউশনিতে। স্কুলে পড়ানোর সুবাদে তার টিউশনির সংখ্যা বেড়ে যায়। তাকে এখন রাত নয়টা-দশটা পর্যন্ত টিউশনি করতে হয়।
এভাবে চলে যায় দুই মাস।
এদিকে মিথিলা তার মামাকে বলেছে, বিদেশে থাকে এমন ছেলের সাথে সে বিয়ে হবে না। এছাড়া সে কাজলের কথা বলেছে। তার মামা বলেছে, কাজলকে বাসায় নিয়ে যেতে।
এক দুপুরে স্কুল থেকে কাজল মেসে ফিরে দেখে একটা খাম। খাম খোলে সে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলো না। সত্যি, আমার চাকরি হয়েছে? বেতন ২০ হাজার টাকা!
সাথে সাথে খবরটা তার মাকে জানায়। জানায় মিথিলাকে। এখন মাসে ১৬ তারিখ। আর মাত্র ১৫ দিন পরই তার নতুন চাকরিতে জয়েন করতে হবে। চাকরির এ্যপয়নমেন্ট লেটারটা পেয়ে সে যেন দীর্ঘ শ্বাস ফেললো। এটার জন্য এত দৌঁড়, এত পরিশ্রম! কত বই-ই না সে পড়েছে। ইংরেজি শিখেছে। খবরের কাগজ পড়েছে। যারা চাকরি করে তাদের পরামর্শ শুনেছে। অনেকে কটুক্তি করে বলেছে, চাকরি এত সহজ না! তাই তো নিজের মাথায় বার বার অজান্তে ‘চাকরি এত সহজ না’ এই কথাটা বাজে।
চাকরি পওয়ার পর ছোট বাসা নেয় কাজল। মাকে দিনাজপুরের গ্রাম থেকে আনে। প্রথম মাসের বেতনের টাকাটা পাওয়ার পর মায়ের হাতে তুলে দেয় কাজল। মা এত টাকা পেয়ে কেঁদে ফেলে। বলে, না বাবা, তোর কাছে রাখ। দোয়া করি, অনেক বড় হবি! কাজল ভাবে, সত্যি আজ আমি জীবন যুদ্ধে জয়ী হয়েছি। আমার মার মন জয় করতে পেরেছি। প্রেমিকার মন জয় করতে পেরেছি।
এর ছয় মাস পর কাজল আর মিথিলার বিয়ে হয়।
কাজল ভাবে, সত্যি জীবন একটা লড়াই। এখানে প্রতিনিয়তই লড়াই করতে হয়। তারপরই না টিকে থাকতে হয়!