শিরোনাম :
প্রতীক্ষা
মনিকা চম্পা গমেজ
নদীর মন ভীষণ অশান্ত! বাইশ বছর পর আজ সে একি শুনলো! ভালবাসার মানে কী, এটা বুঝতে এতটা সময় লাগল অভির? এত বছর পর অভি তার ভুল বুঝতে পেরেছে, সে ভুল করেছে!
প্রাইভেট ফার্মে চাকরি করে নদী। স্বামী-সন্তান নিয়ে সাজানো সুখের সংসার। কষ্টের কোন ছোঁয়া নেই। দেখতে মোটামুটি সুন্দরী, হাসিখুশী, অমায়িক তার ব্যবহার। স্বামী সুদীপ্তও ভাল চাকরি করে। সুন্দর, ভদ্র ও শান্ত স্বভাবের সুদীপ্ত বেশ ভালই রেখেছে নদীকে। বলা যায় ভালবাসায় আগলে রেখেছে ভালবাসার মানুষটিকে।
অভি আর নদী বাল্যকালের সাথী। সারাটা দিন এক সাথেই কাটতো তাদের ছেলেবেলা। হেসে খেলে দিন পার হতো তাদের। একজন আরেকজনকে ছেড়ে যেন থাকতে পারতো না । শৈশব ছেড়ে কৈশরে পা দিল তারা। অভি আস্তে আস্তে ব্যস্ত হয়ে পড়ছিল, এতে নদী কষ্ট পেত, কান্না করত। এমন অবহেলা সহ্য হতো না নদীর। অভি সেটা বুঝতে পেরে নদীকে আরো বেশি কষ্ট দিত। এভাবেই চলছিল দিনগুলো।
একদিন হঠাৎ করেই নদী বুঝতে পারল সে অভিকে ভালবেসে ফেলেছ। সে অভিকে কোনোভাবেই ভালবাসার কথা বলতে পারছিল না। মনে মনে কষ্ট পাচ্ছিল। সামনে নদীর মেট্রিক পরীক্ষা। পড়াশোনায় কোনোভাবেই মন বসাতে পারছিল না, শেষে সিদ্ধান্ত নিল অভিকে ভালবাসার কথা বলবে। একটি ছোট চিরকুট লিখল অভিকে।
‘আমি তোমাকে ভালবাসি অভি। যদি তুমি আমায় ভালবাস তবে আমার শেষ পরীক্ষার দিন অবশ্যই হলের সামনে থাকবে।’
নদী জানে না এর পরিণাম কী হবে। শেষ পরীক্ষার দিন দুরু দরু বুকে নদী পরীক্ষার হলে গেল। কোথাও দেখা গেল না অভিকে। পরীক্ষা শুরু হলো, নদীর খুব কান্না পাচ্ছিল। বান্ধবীদের সহায়তায় পরীক্ষা শেষ করল নদী। বাড়ি ফিরতে হবে। ক্লান্ত, অবসন্ন, মন ভাঙার কষ্ট নিয়ে শেষবারের মতো গেইটের দিকে তাকালো।
হাসি মুখে এক গুচ্ছ ভালবাসা নিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে আছে অভি। খুশিতে কাঁদছিল নদী। অভিকে সেদিন জড়িয়ে ধরতে পারেনি নদী। কারণ সামনে এত মানুষ ছিল যে, সেটা সম্ভব হয়নি। ‘হ্যাঁ, নদী আমিও তোমাকে ভালবাসি বলছিল অভি। তুমি কেন আরো আগে বলনি আমায়? একা একা কষ্ট পাচ্ছ।’
অভি আর নদীর দিনগুলো খুব ভাল চলছিল। অভি ঢাকায় কলেজে পড়ত। ছুটি হলে চলে যেত গ্রামে। কোনো কারণে যেতে না পারলে বন্ধুদের কাছে চিঠি পাঠিয়ে দিত। নদীও প্রতিক্ষায় থাকত কবে অভি আসবে। কখন চিঠি আসবে। দেখতে দেখতে নদীর রেজাল্ট বের হলো। ভালো রেজাল্ট করেছে। বড় ভাই নদীকে কলেজে ভর্তি করিয়ে দিল ঢাকায়। নদী খুব খুশি। ঢাকায় গেলে অভিকে দেখতে পাবে ভেবে। নদীর বাবা ছোট বেলায় মারা গিয়েছে। ভাইদের খুবই আদরের ছিল সে।
নদী হোস্টেলে চলে এলো। মাঝে মাঝে দেখা করতে আসতো অভি। বেশ ভালই যাচ্ছিল ওদের দিনগুলো। ওদের যখন একসাথে দেখা যেত, মনে হতো একই ডালে দুটি ফুল দোল খাচ্ছে বসন্তের বাতাসে।
হঠাৎ করেই একদিন আচমকা এক ঝড় এল ওদের জীবনে। অভির বাবা-মা বিষয়টি জানতে পারে। তারা কোনোভাবেই নদীকে ছেলের বউ করে নিবে না । নদীর ভাইও নদীকে অভির সাথে বিয়ে দিবে না। অভিও যেন কেমন বদলে যাচ্ছিল। নদী অভিকে অনেক বুঝানোর চেষ্টা করেছে। কিন্তু অভি বাবা-মায়ের অজুহাত দেখিয়ে নদীকে ছেড়ে চলে গেল । সেদিন নদী অনেক কেঁদেছিলো। অভির পায়ে ধরে কেঁদেছিল যেন তাকে ছেড়ে না যায়। কিন্তু শুনেনি অভি। বুকভাঙা আর্তনাদ ছিল নদীর। আর ভুল করেও নদীর দিকে ফিরে তাকায়নি অভি। আট মাসের ভালবাসা, ছোটবেলার সাথীর করুন আর্তনাদ। বিন্দুমাত্র স্পর্শ করেনি অভিকে।
দেখতে দেখতে পার হয়ে গেল একটি বছর। নদী শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে, হারিয়ে ফেলেছে চেহারার লাবণ্যতা। ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা শেষ। এর মধ্যে পরিচয় হয় সুদীপ্তর সাথে। সুদীপ্তরও ভাল লাগে নদীকে। ভালবেসেও ফেলে। বাবা-মাকে পাঠায় বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে। নদীর খুব ইচ্ছে ছিল পড়াশোনা করার। কিন্তু অভাবের সংসার, ভাইয়েরা হিমশিম খেয়ে যাচ্ছিল। তখনই সুদীপ্ত বলে, ‘আমি নদীকে পড়াব।’ নদী সুদীপ্তকে তার ভালবাসার অতীত খুলে বলেছে। সব শুনে সুদীপ্ত বলল, ‘এসব কোনো বিষয় না। অনেকের জীবনেই এমন হয়।’
নদীর ডিগ্রী পরীক্ষার পর তাদের বিয়ে হয়। তারপর নদী বিএড, এমবিএ সবই শেষ করেছে সুদীপ্তর ভালবাসায়। আজ নদী ভাল চাকরি করে। বেশ সুখেই আছে সে।
সময় থেমে থাকে না, জীবনও থেমে থাকে না। নতুনত্ব জীবনে বার বার এসে জড়ো হয়। জড়ো হয় শত শত হারিয়ে যাওয়ার শুরুটা। সকল মানুষের মনের অন্তরালে আরেকটি মন থাকে। কেউ বুঝতে পারে, কেউ পারে না। মোবাইল ফোনটা বেজে চলে নদীর। অপর প্রান্ত থেকে অভির কন্ঠস্বর শুনে নদী বোবা হয়ে যায়। জড়ো হয় স্মৃতির ময়লা জমা কথামালা। অভি বলল, ‘আমি ভুল করেছি। তোমার ভালবাসাকে অস্বীকার করেছি। আমি তোমাকে বুঝতে পারিনি, আমাকে ক্ষমা করো।’ এতক্ষণে নদীর দু-চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়তে থাকল ইসদোষ্ণ অশ্রুধারা । এই কান্না কষ্টের নয়; আনন্দের। শেষ পর্যন্ত অভি সে ভালবাসার মর্মার্থ বুঝতে পেরেছে, এটাই নদীর কাছে অনেক কিছু!
আরপি/ এসএন/ ১৭ জানুয়ারি, ২০১৭