শিরোনাম :
ঢাকার নতুন আর্চবিশপ বিজয় এন ডি’ক্রুজের অধিষ্ঠান অনুষ্ঠান
|| ডিসি নিউজ, ঢাকা ||
এক ধর্মীয় ভাব-গাম্বীর্যের মধ্য দিয়ে ঢাকার আর্চবিশপ বিজয় এন ডি’ক্রুজ ওএমইআই-এর আর্চবিশপীয় অধিষ্টান (দায়িত্ব গ্রহণ) অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়।
২৭ নভেম্বর রাজধানীর প্রাণকেন্দ্র কাকরাইলের ক্যাথিড্রালে অনুষ্ঠিত এই আর্চবিশপীয় অধিষ্ঠান অনুষ্ঠানে প্রধান পৌরহিত্য করেন নবনিযুক্ত আর্চবিশপ বিজয় এন ডি’ক্রুজ ওএমআই।
একই দিনে ঢাকা মহা ধর্মপ্রদেশের অবসর গ্রহণকারী আর্চবিশপ কার্ডিনাল প্যাট্রিক ডি’রোজারিও সিএসসিকে আনুষ্ঠানিকভাবে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানানো হয়। পাঠ করা হয় মানপত্র। তাঁদেও হাতে তুলে দেওয়া হয় ভালেবাসার উপহার।
অনুষ্ঠানের শুরুতে সেন্ট মেরীস্ ক্যাথিড্রালের মূলদরজা দিয়ে প্রবেশ করিয়ে নতুন আর্চবিশপকে গ্রহণ করে নেওয়া হয়। অতপর পুণ্যপিতা পোপের প্রতিনিধি ভাটিকানের রাষ্ট্রদূত আর্চবিশপ জর্জ কোচেরী অধিষ্ঠানের অনুজ্ঞাপত্র ঘোষণাপূর্বক নতুন আর্চবিশপের অধিষ্ঠানপর্বটি পরিচালনা করেন। এ সময় তাদের সাথে ছিলেন কার্ডিনাল প্যাট্রিক ডি’রোজারিও।
পবিত্র খ্রিষ্টযাগের উপদেশে নতুন আর্চবিশপ বলেন, আমরা যিশুর শিষ্য হওয়ার জন্য আহ্বান পেয়েছি। ঈশ্বর নিজ কথা প্রবক্তাদের মুখ দিয়ে বলেছেন। আমরা অযোগ্য কিন্তু ঈশ^র চান তার জনগণ তার মতো হয়ে উঠবে।
আর্চবিশপ বিজয় আরো বলেন, ‘এই ধর্মপ্রদেশে রয়েছে অনেক অভিজ্ঞ পবিত্র যাজক, ব্রতধারীণী ও খ্রিষ্টভক্ত, তারাই হবে আমার চলার পথের শক্তি। বিশপীয় আন্তধর্মীয় সংলাপ কমিশনের চেয়ারম্যান আর্চবিশপ বিজয় বলেন, ধর্মবিশ^াসের একটা শক্তি আছে। আমি বিভিন্ন ধর্মের ধর্মীয় নেতাদের সাথে মিশেছি। তাদের সাথে চলে আমি অনুপ্রাণীত হয়েছি। আমি বুঝতে পেরেছি ধর্ম একতা সৃষ্টি করতে পারে। কারণ আমরা সব মানুষ এক সৃষ্টিকর্তার জীব।’
তিনি আরো বলেন, ‘আমাদের শুধু শিক্ষা দাতা নয় সাক্ষ্য দাতা হতে হবে। এখন বর্হিমুখি হতে হবে। আমাদের রয়েছে কত সুন্দর সুন্দর প্রতিষ্ঠান। যেমন কারিতাস, ভালো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। আমরা আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্য দিয়ে সাক্ষ্য দাতা হয়ে উঠবো।’
ঢাকার অবসরপ্রাপ্ত আর্চবিশপ কার্ডিনাল প্যাট্রিক ডি’রোজারিও তাঁর উত্তরসরি আর্চবিশপ বিজয় এন ডি’ক্রুজকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, ‘তুমি আমাদের পরিচালক, তুমি যে প্রভুর মনোনীত জন। প্রভুর মনোনীত জন রূপে পুণ্যপিতা পোপ মহোদয় তোমাকে বেছে নিয়েছেন। তুমি প্রিয়জন ও প্রিয় পালক। তোমাকে জানাই অন্তরভরা অভিনন্দন। তোমার কন্ঠস্বর শুনতে আমরা উন্মুক।’
অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন রাজশাহীর বিশপ জের্ভাস রোজারিও, ঢাকা মহাধর্মপ্রদেশের সহকারী বিশপ এবং প্রশাসক বিশপ শরৎ ফ্রান্সিস গমেজ, ঢাকার অবসরপ্রাপ্ত সহকারী বিশপ থিয়োটনিয়াস গমেজ সিএসসি, ময়মনসিংহের বিশপ পল পনেন কুবি সিএসসি, খুলনার বিশপ রমেন বৈরাগী, দিনাজপুরের বিশপ সেবাষ্টিয়ান টুডু, চট্টগ্রামের প্রশাসক ফাদার লেনার্ড রিবেরুসহ বিভিন্ন ধর্ম সংঘের প্রধানগণ।
বিশপদের পক্ষে বক্তব্য দেন ময়মনসিংহের বিশপ পল পনেন কুবি সিএসসি। তিনি বলেন, ‘বিশপদের পক্ষে ঢাকার নতুন আর্চবিশপ বিজয় এন ডি’ক্রুজকে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানাই। আমাদের পূর্ণ সমর্থন ও সহযোগিতা থাকবে তাঁর জন্য।’
পবিত্র খ্রিষ্টযাগের পর শুরু হয় নব অধিষ্ঠান লাভকারী আর্চবিশপ বিজয়ের সম্বর্ধনা অনুষ্ঠান এবং বিদায়ী আর্চবিশপ কার্ডিনাল প্যাটিকের ধন্যবাদ-কৃতজ্ঞতা অনুষ্ঠান।
অধিষ্ঠান ও ধন্যবাদ জ্ঞাপন অনুষ্ঠানের সমন্বয় কমিটির চেয়ারম্যান ও ঢাকা মহাধর্মপ্রদেশের প্রশাসক বিশপ শরৎ ফ্রান্সিস গমেজ অনুষ্ঠানে বলেন, ‘আজকের উপাসনায় করোনাভাইরাসের কারণে সীমিত পরিসরে ক্যাথিড্রালের ভেতরে অনুষ্ঠিত হওয়ায় ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও সকলকে সরাসরি অংশগ্রহণের সুযোগ দিতে পারি নাই বলে আমরা দুঃখ প্রকাশ করছি। যাঁরা এখানে উপস্থিত এবং যাঁরা অনলাইনে অনুষ্ঠানে আমাদের সাথে অংশগ্রহণ করছেন, তাঁদের সকলকে শুভেচ্ছা ও স্বাগত জানাই।’
প্রসঙ্গত, খ্রিষ্টীয় যোগাযোগ কেন্দ্রের সাপ্তাহিক প্রতিবেশী ও ঢাকা ক্রেডিটের অন লাইন টিভি ডিসি টিভিতে অধিষ্ঠান ও ধন্যবাদ জ্ঞাপন সরাসরি সম্প্রচার করা হয়। ফলে যাঁরা স্বশরীরে অনুষ্ঠানে অংশ নিতে পারেননি, তাঁরা অন লাইনের মাধ্যমে অংশ গ্রহণ করেছেন।
খ্রিষ্টভক্তদের পক্ষে গোল্লা ধর্মপল্লীর মি. টমাস রোজারিও বলেন, ‘আমরা আমাদের নতুন আর্চবিশপ বিজয়কে আন্তরিকভাবে স্বাগত জানাই। আমরা তাঁকে সর্বাত্মকভাবে সহযোগিতা করবো।’ তিনি প্রাক্তন আর্চবিশপ কার্ডিনাল প্যাট্রিককে তাঁর অবদানের জন্য কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন।
ধর্মপ্রদেশীয় যাজকদের পক্ষে বক্তব্য দেন ফাদার জয়ন্ত এস গমেজ। তিনি আর্চবিশপ বিজয়কে বলেন, ঢাকার পুরোহিতগণ আপনার প্রতি পূর্ণ আনুগত্য ও আকাত্ম হয়ে ধর্মপ্রদেশ ও ঐশজনগণের সেবা করার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করছেন। প্রার্থনা করি মঙ্গলময় পিতাসআপনাকে প্রজ্ঞা দান করুন।
আরো বক্তব্য দেন অধিষ্ঠান ও ধন্যবাদ জ্ঞাপন অনুষ্ঠানের সমন্বয় কমিটির কোÑঅডিনেটর ফাদার ডেভিড গমেজ এবং হলি ক্রস ব্রাদারদের প্রভিন্সিয়াল ব্রাদার সুবল এল রোজারিও সিএসসি।
অনুষ্ঠানে রাজনৈতিক ব্যক্তিদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন মানেনীয় প্রধান মন্ত্রীর বিশেষ সহকারী ব্যরিষ্টার বিপ্লব বড়ুয়া, দুইজন খ্রিষ্টান সংসদ অ্যাডভোকেটি জুয়েল আরেং, এমপি ও অ্যাডভোকেট গ্লোরিয়া ঝর্ণা সরকার, এমপি, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির উপ-দপ্তর সম্পাদক সায়েম খান, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সদস্য ও ঢাকা ক্রেডিটের পরামর্শক উপাধ্যক্ষ রেমন্ড আরেং।
অধিষ্ঠান খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের বিশেষ ব্যক্তিদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা ক্রেডিটের প্রেসিডেন্ট পংকজ গিলবার্ট কস্তা, বাংলাদেশ খ্রীষ্টান এসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট নির্মল রোজারিও, কারিতাস এশিয়ার প্রেসিডেন্ট ড. বেনেডিক্ট আলো ডি’রোজারিও, কারিতাসের নির্বাহী পরিচালক রঞ্জন রোজারিও, ঢাকা ক্রেডিটের ভাইস-প্রেসিডেন্ট আলবার্ট আশিস বিশ^াস, সেক্রেটারি ইগ্নাসিওস হেমন্ত কোড়াইয়া, ট্রেজারার পিটার রতন কোড়াইয়া, জাতীয় ওয়াইএমসিএ’র প্রেসিডেন্ট ও ঢাকা ক্রেডিটের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট বাবু মাকুর্জ গমেজ, দি মেট্রোপলিটান খ্রীষ্টান কো-অপারেটিভ হাউজিং সোসাইটি লি: এর চেয়ারম্যান আগষ্টিন পিউরীফিকেশন, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জিব দ্রংসহ ৪৫০ জন খ্রিষ্টভক্ত।
অনুষ্ঠানে অন্য ধর্ম ও মন্ডলীর প্রতিনিধিবর্গও অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে ঢাকার নতুন আর্চবিশপ বিজয়ের প্রতি সমর্থন ও ভালোবাসা প্রকাশ করেছেন। তাদের মধ্যে উল্লেখ যোগ্যরা হলেন: হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতি ড. নিম চন্দ্র ভৌমিক, বাংলাদেশ বুডিস্ট ফেডারেশনের প্রেসিডেন্ট ইঞ্জিনিয়ার দিবেন্দু বিকাশ চৌধুরী বড়ুয়া ও সেক্রেটারি জেনারেল ভিক্ষু সনন্দ প্রিয়, বাংলাদেশ চার্চ পরিষদের সেক্রেটারি জেনারেল দীপক অনুরুদ্ধ দাশ, বিবিএফ’র লিওর পি সরকার, চার্চ অব বাংলাদেশের মি: জেমস সুব্রত হাজরা।
করোনা পরিস্থিতিতে অনুষ্ঠানটিতে কেবল মাত্র ধর্মপল্লী বা প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিগণ উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠান শেষে বিভিন্ন ধর্ম সংঘ, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, ঢাকা ক্রেডিট, হাউজিং সোসাইটিসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পক্ষে নবনিযুক্ত আর্চবিশপ বিজয় ও বিদায়ী আর্চবিশপ কার্ডিনাল প্যাট্রিককে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা প্রকাশ করা হয়।
ঢাকা ক্রেডিটের প্রেসিডেন্ট পংকজ গিলবার্ট কস্তা ফুল দেওয়ার সময় আর্চবিশপ বিজকে বলেন, ঢাকা ক্রেডিটের ৪৩ হাজার সদস্যের পক্ষে আমরা আপনাকে শুভেচ্ছা জানাই। আপনার সফলতা, সুস্বাস্থ্য ও দর্ঘায়ু কামনা করি।
প্রসঙ্গত, ৩০ সেপ্টেম্বর ঢাকা মহাধর্মপ্রদেশের আর্চবিশপ কার্ডিনাল প্যাট্রিক ডি’রোজারিও সিএসসি’র ঢাকা মহাধর্মপ্রদেশের কর্মদায়িত্ব থেকে অবসর গ্রহণের আবেদনটি মুঞ্জুর করে তাঁর স্থলে সিলেট ধর্মপ্রদেশের বিশপ বিজয় এন ডি’ক্রুশ ওএমআইকে ঢাকা মহাধর্মপ্রদেশের আর্চবিশপ হিসেবে মনোনয়ন দেয় ভাটিকান। আর্চবিশপ সরকার ও খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের মধ্যে মেলবন্ধন এবং বর্হিবিশ্বে খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের সাথে সম্পর্ক স্থাপনে অগ্রণী ভূমিকা রাখেন।
আর্চবিশপ বিজয় এন ডি’ক্রুজের জন্ম নবাবগঞ্জের পুরান তুইতাল গ্রামে ৯ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দে। তিনি যখন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়তেন তখন তাঁর বাবা গোল্লা ধর্মপল্লীতে বাড়ি করেন। তাঁর বাবা মধ্য প্রাচ্যে চাকরি করতেন। বাবা যখন দেশে আসতেন তখন তিনি দেখতেন ধর্মের প্রতি তাঁর বাবার কত ক্ষুধা। তাঁর বাবার ভক্তি পুষ্পের প্রার্থনা সব মুখস্ত ছিলো। তিনি সব সময় রোজারি মালা করতেন।
আর্চবিশপ বিজয় যখন কিশোর ছিলেন, তখন শহীদ ফাদার ইভান্স সিএসসি’র পবিত্র জীবন দেখে তিনি নিজে ফাদার হতে অনুপ্রেরণা লাভ করেন। এ ছাড়া তিনি যখন বান্দুরা স্কুলে পড়তেন তখন হলি ক্রস ব্রাদারদের সুন্দর জীবনাচরণ দেখে ধর্মীয় জীবনের প্রতি তাঁর আকর্ষণ বৃদ্ধি পায়।
তিনি পুরোহিত হন ২০ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৭ খ্রিষ্টাব্দে। ঢাকার আর্চবিশপের দায়িত্ব পালনের আগে তিনি খুলনা ও সিলেটের বিশপ হিসেবে সেবা দিয়েছেন।