শিরোনাম :
আমাদের উৎসবগুলো
পার্থ শঙ্কর সাহা
সিনিয়র সাব-এডিটর, দৈনিক প্রথম আলো
ঘটনাটি আমার এক সহকর্মীর কাছে থেকে শোনা। সেই সহকর্মীর বাড়ি দেশের উত্তরাঞ্চলের লালমনিরহাট জেলায়। একবার লালমনিরহাটের হাতিবান্ধা উপজেলার বনচুকি গ্রামে আত্মীয়বাড়িতে গিয়েছিলেন তিনি। তখন পূজোর সময়।
কিন্তু এ পূজো তাঁকে আশ্চর্য করে। ভারতীয় সীমান্ত সংলগ্ন গ্রামটি। সেখানে একটি মাদ্রাসার মাঠে হয় দুর্গাপূজা। গ্রামে বড় জায়গা বলতে ওই মাঠটিই। তাই সেখানে ফি বছর হয় পূজোর আয়োজন। গ্রামের হিন্দু-মুসলমান সবাই এভাবেই অভ্যস্থ হয়ে গেছেন। তাদের কাছে এটি স্বাভাবিক বিষয়। কর্মজীবনে এসে আমার সেই সহকর্মীর স্মৃতিচারণ আমাদের বিস্মিত করে, আমাদের আপ্লুত করে। কিন্তু হয়তো এটাই পূণ্যতীর্থ বাংলাদেশের সহজাত রূপ। দেশীয়-বৈশ্বিক নানা ঘটনাপ্রবাহে আমাদের সেই রূপ হয়তো ফিকে হয়ে গেছে। কিন্তু হারিয়ে যায়নি।
বিভিন্ন ধর্মের ভিন্ন ভিন্ন উৎসব আছে। কিন্তু আমরা সেই উৎসবের আনন্দ ভাগ করতে ভুলে যাইনি। উৎসব তো আসলে তাই যখন কিনা মানুষ নিজেকে ভুলতে পারে আনন্দের আতিশয্যে। নিজেকে হারাতে না পারলে কীসের উৎসব? আমাদের মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের বড় দুই উৎসব দুই ঈদ, হিন্দুদের দুর্গাপূজা, খ্রিষ্টানদের বড়দিন এবং বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের বৌদ্ধ পূর্ণিমা-সব কেবল শুধু এসব জনগোষ্ঠীর উৎসব হয়ে থাকেনি। পরিণত হয়ে গেছে সর্বজনীন উৎসবে। এর পাশাপাশি পাহাড়ের মানুষের বর্ষ বিদায় ও বরণের উৎসব বৈসাবিও (বৈসুক-সাংগ্রেই-বিজু) দেশের উৎসবের তালিকায় এক অনন্য সংযোজন।
নিজেকে হারানোর যে কথাটা বললাম তেমন নির্মল উৎসবের কথা খুঁজে পাই কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতায়:
ভুলে গিয়ে রাজ্য-জয়-সাম্রাজ্যের কথা
অনেক মাটির তলে যেই মদ ঢাকা ছিলো তুলে নেবো তার শীতলতা;
ডেকে নেবো আইবুড়ো পাড়াগাঁর মেয়েদের সব;
মাঠের নিস্তেজ রোদে নাচ হবে-
শুরু হবে হেমন্তের নরম উৎসব।
হাতে হাত ধ’রে-ধ’রে গোল হ’য়ে ঘুরে-ঘুরে-ঘুরে
কার্তিকের মিঠে রোদে আমাদের মুখ যাবে পুড়ে;
ফলন্ত ধানের গন্ধে- রঙে তার- স্বাদে তার ভ’রে যাবে আমাদের সকলের দেহ;
রাগ কেহ করিবে না- আমাদের দেখে হিংসা করিবে না কেহ। (উৎসবের গান)
এমন বিদ্বেষহীন, হিংসাহীন উৎসব তো আমরা সবাই চাই। উৎসবে রাগ বা হিংসার কথা আসবেই বা কেন? এগুলো তো আর উৎসব হলো না।
আমরা এ দেশের মানুষ সহাবস্থানে অভ্যস্ত। আমাদের প্রায় প্রত্যেকের শিশুকাল থেকে বেড়ে ওঠার স্মৃতিতে অন্য ধর্মের মানুষের উৎসবে অংশ নেওয়ার স্মৃতি আছে। আমরা ছোটকালে ভেদাভেদ বুঝতে পারি না। যত বড় হই ততো ভেদবুদ্ধি মাথায় ঢোকে। আমরা শারীরিকভাবে বড় হই, মন বড় হয় না। তাইতো বিপত্তি বাধে। কিন্তু উৎসবের মর্মার্থ যদি আমরা বোঝার চেষ্টা করি তাহলে দেখবো, সেগুলোর মধ্যে সর্বজনীনতা আছে। মানুষ নিজেদের মতো করে উৎসবের রূপ দিয়েছে।
এই ঢাকায় ঈদুল ফিতরে পুরনো ঢাকায় মিছিল অনেক পুরনো একটি রীতি। তাতে সব ধর্মের মানুষ অংশ নেয়। অন্য ধর্মের মানুষদের মুসলিমদের বাড়িতে যাওয়া, উৎসবে অংশ নেওয়া এক পরিচিত দৃশ্য।
ঈদুল আজহায় অনেক মুসলিম পরিবারকে জানি, যারা গোমাংসের বাইরে অন্য পশুর মাংসের ব্যবস্থা রাখেন শুধু অমুসলিম বন্ধুদের আপ্যায়নের জন্য। এটাই বাংলাদেশ।
বাঙালি হিন্দুদের সবচেয়ে বড় উৎসব দুর্গাপূজা। এই পূজায় ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের অংশগ্রহণ থাকে। উৎসবে প্রতিমা দর্শন, পূজোর প্রসাদ খাওয়াসহ সব আয়োজনেই থাকে সবার অংশগ্রহণ।
এ প্রসঙ্গে একটু ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলি। উত্তরবঙ্গের যে জনপদে আমার জন্ম সেখানে দুর্গাপূজা হয় জাকজমকভাবে। পূজোর শেষ দিনে অর্থাৎ দশমীর দিনে একটা বড় মেলা হতো। এখন আর হয় না। আমি একবার দশমির দিনে আমার মুসলিম বন্ধুর বাড়িতে গিয়ে দেখি, ওর মামা ওকে মেলা দেখার জন্য টাকা দিচ্ছেন। এটা নাকি ছোটবেলা থেকেই ও পেয়ে আসছে। আর আমাদের পূজোতে মুসলিমদের নানাভাবে অংশগ্রহণ তো অনিবার্য ছিল।
‘এমন পুলক তৈরি হয় শীতের আগমনে। দেশের খ্রিষ্টানদের সংখ্যা খুব বেশি না। কিন্তু খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী অধ্যুষিত এলাকায় এ উৎসবের আনন্দ সকলের মধ্যে ছড়িয়ে যায়। আমি এই রাজধানীতে ডিসেম্বরের শুরু থেকে উন্মুখ হয়ে থাকি দলবেঁধে করা কীর্তনের জন্য। মূলত কিশোর-কিশোরীদের সমন্বয়ে গড়া সব কীর্তনের দল খ্রিষ্টান বাড়িগুলো ঘুরে বেড়ায়।’
শহরের একপাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া করতেয়া নদীতে ভাসান হতো। দূর গ্রামে নৌকা চালকেরা আসতেন সে সময়। তাদের প্রায় সবাই মুসলমান। করতোয়া এখন শীর্ণ হয়ে গেছে। অনেক দশমী আসে, নদীর বুকে নৌকা চলার পানিও থাকে না। শীর্ণ নদী আর দশমীর দিনের নৌকাভাসান না হওয়ার জন্য কষ্টবোধ আমি নদীপাড়ের অনেক মুসলিমের মধ্যে দেখেছি।
আমাদের দেশে সরস্বতী পূজা সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এক উৎসবের আমেজ নিয়ে আসে। এর নানা পর্বে আমি ভিন্ন ধর্মের শিক্ষার্থীদের অংশ নিতে দেখেছি।
বুদ্ধপূর্ণিমা বা বৈশাখী পূর্ণিমা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের প্রধান উৎসব। এই বৈশাখ মাসের পূর্ণিমা তিথিতে এ উৎসব হয়। বুদ্ধের তিনটি স্মৃতি ঘিরে এটি পালিত হয়। এ তিথিতে বুদ্ধ জন্মগ্রহণ করেছিলেন, বোধি লাভ করেছিলেন আবার মহাপরিনির্বাণ লাভ করেছিলেন। এ দিনে বৌদ্ধরা মন্দিরে গিয়ে বুদ্ধের কাছে প্রার্থনা করেন।
বৌদ্ধদের প্রবারণায় ফানুস ওড়ানো হয়। এ ফানুসের রশ্মি নিশ্চয়ই সবার মধ্যে পুলক তৈরি করে।
এমন পুলক তৈরি হয় শীতের আগমনে। দেশের খ্রিষ্টানদের সংখ্যা খুব বেশি না। কিন্তু খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী অধ্যুষিত এলাকায় এ উৎসবের আনন্দ সকলের মধ্যে ছড়িয়ে যায়। আমি এই রাজধানীতে ডিসেম্বরের শুরু থেকে উন্মুখ হয়ে থাকি দলবেঁধে করা কীর্তনের জন্য। মূলত কিশোর-কিশোরীদের সমন্বয়ে গড়া সব কীর্তনের দল খ্রিষ্টান বাড়িগুলো ঘুরে বেড়ায়। পাড়াগুলো বড়দিনের আগমনী বার্তা পায় এই কীর্তনের ধ্বনিতে।
যিশুখ্রিষ্টের জন্মদিনের এ উৎসব এখন বাংলাদেশে এক সর্বজনীন রূপ পেয়েছে। ক্রিসমাস ট্রি বা সান্তাবুড়োর প্রতিকৃতি কেবল তো খ্রিষ্টান পরিবারই খরিদ করে না, এর ক্রেতা অন্য ধর্মের মানুষেরাও। বড় বড় হোটেলগুলো বড়দিন উপলক্ষে নানা আয়োজন করে। তাতেও সর্বজনীন অংশগ্রহণ চোখে পড়ে।
এসব ধর্মীয় উৎসবের পাশাপাশি আছে আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী মানুষদের বৈসাবী উৎসব। কিছুদিন আগে সরকার বৈসাবী উপলক্ষে স্থানীয় ছুটি ঘোষণা করেছে। এটি এটি বড় উদ্যোগ নিঃসন্দেহে। এখন অনেক বাঙালিকে বর্ষ বরণ ও বিদায়ের এ লগ্নে পাহাড়মুখো হতে দেখি।
এই বৈচিত্র্য আসলে আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছে। শুধু আমাদের কেন, বিশ্ব সভ্যতাই টিকে আছে বৈচিত্র্যের এই ঐক্যতনের ওপর ভর করে। আমরা অনেকেই আছি সেই সৌন্দর্যকে স্বীকার করতে চাই না। এতে আখেরে এসব মানুষেরই ক্ষতি হয়। ভিন্নতাকে, ভিন্ন মতকে যদি গ্রহণ না করতে পারি তবে সমাজজীবন দূর্বিষহ হয়ে পড়ে। উৎসব আমাদের শুধু নির্মল আনন্দ দেয় না। এটি আমাদের উদার হতে শেখায়।
‘রমজানের ওই রোজার শেষে এল খুশির ঈদ- এ গান শরীরে উৎসবের হিল্লোল যদি না তোলে, ঢাকের কাঠিতে মনটা যদি কারও না নাচে, অন্ধকারে কোনো দূর পাহাড়ের বৌদ্ধ মন্দির থেকে উড়ানো ফানুস আনন্দ না দেয়, শীতের এই সরস সময়ে গির্জাঘরের ঘণ্টাধ্বনী, লালকাপড়ে ঢাকা সান্তা বুড়ো বা ক্রিসমাস ট্রি মনকে আনন্দে ভরিয়ে না তোলে তবে কারও ক্ষতি নেই। ক্ষতি সেই মানুষের যে বা যারা এসব থেকে আনন্দ নিতে পারেন না। তারা সত্যিই দুর্ভাগা।