ঢাকা ,
বার : সোমবার
তারিখ : ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
বাংলা : ৯ পৌষ ১৪৩১
Dcnewsbd Facebook
Dcnewsbd Twitter

শিরোনাম :

প্রথম পাতা ফিচার শ্রদ্ধা ও ভালবাসায় দেশবরেণ্য রাজনীতিক এড. প্রমোদ মানকিনকে স্মরণ: শোকসভায় হাজারো মানুষের...

শ্রদ্ধা ও ভালবাসায় দেশবরেণ্য রাজনীতিক এড. প্রমোদ মানকিনকে স্মরণ: শোকসভায় হাজারো মানুষের ঢল

0
1918

১১ ফেব্রুয়ারি, সকাল সাড়ে দশটা। ময়মনসিংহ শহরের শম্ভুগঞ্জ ব্রীজ থেকে ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা টীম মাইক্রোবাসে যোগ দেয়। গন্তব্য ময়মনসিংহের হালুয়াঘাটের ভারত সীমান্তের রাংরাপাড়ার মমতা ভবন। টীম মাইক্রোবাসে বাংলাদেশ খ্রীষ্টান এসোসিয়েশন ও ঢাকা ক্রেডিটের নেতৃবৃন্দ রয়েছেন। শম্ভুগঞ্জ পার হয়ে গাড়ি দ্রুতবেগে মমতা ভবনের দিকে যেতে থাকে। যেতে যেতে অনেকগুলো বাস, মাইক্রোবাস ও মোটরসাইকেল চোখে পড়ে। অতিক্রম করে সামনে এগুতে থাকি। তাদের গাড়ির ভেতরেও শ্রদ্ধাঞ্জলী লেখা ফুলের রিং, ফুলের তোড়া। বাকি পথ একটু পর পর এমন দৃশ্য চোখে পড়েছে। সবারই গন্তব্য মমতা ভবন। প্রিয় নেতার শোক সভায় সামিল হওয়া। দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে ততক্ষণে টিম মাইক্রোবাস হালুয়াঘাট-ধোবাউড়া সংযোগ সড়ক হয়ে বামের রাস্তা ধরে মমতা ভবনের দিকে যেতে থাকে।

পথিমধ্যে শতশত মানুষের ভিড়। অটো রিক্সা, পায়ে হেঁটে কেউবা সিএনজিতে করে মমতা ভবনের দিকে যাচ্ছেন। বিড়ইডাকুনী সাধ্বী এলিজাবেথের গির্জা অতিক্রম করে মাইক্রোবাস থেকে নেমে সামনে পা বাড়াতেই প্রধান তোরণ চোখে পড়ে, যেখানে তিনি দাঁড়িয়ে হাসিমুখে সবাইকে সম্ভাষণ জানাচ্ছেন। প্রধান তোরণ থেকে নির্মিত মঞ্চের পেছন ভাগ পর্যন্ত রাস্তার দুইধারে কয়েকশ গজ দূরত্বে প্রিয় নেতার ছবি ও বিভিন্ন উক্তি সম্বলিত ফেস্টুন দিয়ে রাঙিয়ে দেওয়া হয়েছে। ততক্ষণে শোকসভা শুরু হয়ে গেছে। শোকসভায় হাজারো মানুষের ঢল, তিল ধারণেরও জায়গা নেই। সাদা-কালোর কম্বিনেশনে খুবই নান্দনিকতার সাথে শোকসভার মঞ্চ নির্মাণ করা হয়েছে। সবার দৃষ্টি সেদিকেই। মঞ্চের মাঝখানে প্রিয়নেতার হাসোজ্জল পোট্রেট রাখা। শিল্পি মনের সব মাধুরী মিশিয়ে যেন নিখুঁত ভাবে তাঁর এই পোট্রেটটি এঁকেছেন। পোট্রেটের উপর থেকে চোখ সরতেই চায়না। পোট্রেটের ডান কোনায় উপরে খুতুব (পাগড়ী) পড়ানো। এই খুতুব বা পাগড়ী গারোদের সম্মান ও মর্যাদার প্রতীক। সমাজে উচ্চ আসনে আসীন ব্যক্তিদের সম্মান জানিয়ে এই খুতুব পড়িয়ে দেওয়া হয়। পোট্রেটের উপরের বাম ও ডান কোনায় সাদা এবং লাল গোলাপের মালা পরিয়ে দেওয়া হয়েছে। পোট্রেট জুড়ে নানা ফুল। পোট্রেটের পিছনে পবিত্র ক্রুশ স্থাপন করা। 02মঞ্চের বাম পাশেই চিরনিদ্রায় শায়িত হয়ে আছেন সবার প্রিয় ও অবিসংবাদিত নেতা এড. প্রমোদ মানকিন। সমাধিস্থান ফুলে ফুলে ভরে গেছে। সমাধিস্থলে তাঁর মাথার উপরেও পবিত্র ক্রুশ স্থাপন করে ক্রুশের উপরিভাগে খুতুব পরিয়ে দেওয়া হয়েছে। চারপাশে মোমবাতি প্রজ্জ্বলন করা হয়েছে।

সার্বজনীন প্রার্থনায় বিভিন্ন ধর্মের প্রতিনিধিরা প্রিয় নেতার আত্নার চিরশান্তি কামনায় প্রার্থনা করেছেন। তাঁর নির্বাচনী এলাকা ময়মনসিংহ-১ (হালুয়াঘাট-ধোবাউড়ার) আসনের হাজার হাজার ভক্ত-অনুরাগী ছাড়াও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ, বিদেশী অতিথি এবং দেশের নানা প্রান্ত থেকে তাঁর ভক্তরা শোকসভায় যোগ দিয়েছিলেন। কেউ আমন্ত্রন পেয়ে কেউ আমন্ত্রন না পেয়ে শুধু স্মরণ সভার কথা শুনেই ছুটে এসেছেন। সবার হাতেই ফুল, চোখে-মুখে শোকের ছাপ, প্রিয় নেতাকে হারানোর বেদনা।

স্মৃতিচারণা করতে এসে অনেকেই চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি। স্মৃতিচারণায় তাঁর রাজনৈতিক সহযোদ্ধা, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, প্রজাতন্ত্রের কর্মচারি ছাড়াও বিভিন্ন ধর্মের প্রতিনিধি ও সাধারণ মানুষ কথা বলেছেন। তারা তাঁকে দেশবরেণ্য, কিংবদন্তী, মহানায়ক ও অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে আখ্যায়িত করেন। তারা বলেন, ‘তিনি বহুমত ও পথকে একসাথে ধারণ করেছেন। সবধর্মের মানুষকে ভালবেসেছেন ও সমান মর্যাদা দিয়েছেন। তাঁর নির্বাচনী এলাকাসহ তিনি দেশব্যাপী যে উন্নয়ন করে বেরিয়েছেন তা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।’ তাঁরা আরো বলেন, ‘তিনি একজন সুদর্শন ও আদর্শ রাজনীতিক ছিলেন। এই অঞ্চলের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অবকাঠামো, রাস্তাঘাট, কৃষি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উৎকর্ষ সাধনে তিনি যে অবদান রেখে গেছেন তা এ জনপদের মানুষ চিরকাল মনে রাখবে।’ 03বাবার শোককে হৃদয়ে ধারণ করে পাঁচ মেয়ে সাদা-কালো পাড়ের শাড়ি পরেছিলেন।

ছেলে জুয়েল আরেং এর গায়ে কালো মুজিব কোর্ট। দাদু হারানোর বেদনায় নীল নাতি-নাতনি, সবাই শোকে বিহ্বল। ক্যামেরার লেন্স একটি মুখ বারবার খুঁজে ফিরেছে। আর তিনি হলেন মমতা আরেং, প্রিয় নেতার সহধর্মিনী। এক সময় ক্যামেরা ঠিকই খুঁজে পায় সেই প্রিয় মুখ। শোকসভা মঞ্চের সামনে নীরবে, দু’হাত করজোরে বসে আছেন তিনি। ৫২ বছর একসাথে পথ চলেছেন। কি করে ভুলবেন তিনি সেই দিনের স্মৃতিগুলো? একজন বন্ধু, সহযাত্রী আর স্বামী হাড়ানোর কষ্ট কি করে ভুলবেন, বুঝানো যায় কি সেই বেদনা? বাকি সময় নতজানু হয়ে, দু’হাত তুলে সৃষ্টিকর্তার কাছে তাঁকে প্রার্থনা করতে দেখেছি।

সীমান্তের মহানায়ক আখ্যা দিয়ে মঞ্চের বামপাশে তাঁকে নিয়ে আলোকচিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছে। যেখানে তাঁর বিভিন্ন উন্নয়ন কার্যক্রম জীবন্ত হয়ে ফুটে উঠেছে। যে উন্নয়ন ও কাজের জন্যে তিনি হয়ে উঠেছেন এখানকার গনমানুষের অবিসংবাদিত নেতা, হয়েছেন দেশবরেণ্য রাজনীতিক। সবাই নির্বাক তাকিয়ে দেখছেন তাঁর উন্নয়ন কর্মচিত্র।
শুধু তাঁর সমাধিস্থান নয়, স্মরণসভার দিন অনেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাঁর প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানিয়ে বিভিন্ন পোষ্ট দিয়েছেন। ফেসবুকে তাঁকে নিয়ে হুমায়ুন কবির মানিক নামে এক ভক্ত কবিতা লিখেছেন। মানিক লিখেছেন….
‘শান্ত হয়ে ঘুমিয়ে আছ, মমতার প্রিয় কবি
আল্পনাতে হৃদয় মাঝে, আঁকা তোমার ছবি।
পাপড়ির মত কোমল ছিল, তোমার সবুজ প্রাণ,
মুক্তির পথে পদচারনা, মানবতার জয়গান।
রুবির চোখে শান্তির বাণী, ছড়ালে জগৎময়,
মালার মালা গলায় পড়ে,
করেছ বিশ্বজয়।
জুয়েল তোমার প্রতিচ্ছবি, সকল স্বপ্ন স্বাদ,
স্বর্গ থেকে করো তুমি, মধুর আশির্বাদ।’

05তাঁকে নিয়ে ‘শোভিত মোরা তব জ্যোর্তিময়’ নামে একটি ছোট্ট স্মরণিকাও প্রকাশ করা হয়েছে। যেখানে তাঁকে প্রকৃত দেশপ্রেমিক ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, অগ্রপথিক ও ছায়াদানকারী, শান্তি ও সম্প্রীতির অগ্রদূত, গারো সমাজের ধ্রুবতারা, প্রিয় শিক্ষক প্রিয় নেতা, স্বপ্নদ্রষ্টা, একজন উজ্জল অশ্বারোহী, আলোকিত মানুষ, মন্ডলী, সমাজ ও রাষ্ট্রের কর্ণধার, কিংবদন্তী ও বিনয়ী মানুষের মূর্তপ্রতীক এবং সাধারণ দীন-দু:খী মানুষের ভরসাস্থল হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। তিনি ছিলেনও তাই। তাঁর প্রতি যথাযথ মর্যাদা ও সম্মান দেখিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিদের্শে মমতা ভবনের কয়েকশ গজ উত্তরে তাঁর নামে একাডেমির কাজ দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলছে। যেখানে মহান নেতার বিভিন্ন কর্মের উপর একটি মিনি মিউজিয়াম, অডিটরিয়াম, সভাকক্ষসহ শিল্প ও সংস্কৃতি সংরক্ষণাগার এবং সংস্কৃতি চর্চা কেন্দ্র থাকবে।

কবি মতেন্দ্র মানখিনও দেশবরেণ্য এই নেতাকে নিয়ে গান রচনা করেছেন। গানের কথাগুলো এরকম…..
প্রমোদ মানকিন, স্মরণীয় একটি নাম
(রাখি) তব চরণে ভক্তি প্রণাম।
তিনি থাকবেন চিরদিন আলোকিত তাই
পুলকিত তাই মর্ত্তধাম, প্রণাম।
প্রণাম, প্রণাম।
আঁধার কেটে দু:খ স্মৃতি অমানিশা মুছে যাক
সবার হৃদয়ে নতুন প্রাণের বান ডেকে যাক।
ধ্রুবতারার মত আলোর দিশারী হয়ে
তিনি মোদের পথ দেখাবেন প্রতিক্ষণে অবিরাম।
প্রণাম প্রণাম।
জীবন যুদ্ধে দু:খ জয়ের তিনি হবেন প্রেরণা
সাজাবো মোরা ফুল ফসলে নিজেদের ঠিকানা।
মাটি ও মানুষ আর মানবতার চেতনা
করবো মোরা জয় ভালবাসাতে অশুভ পরিনাম।  

প্রণাম, প্রণাম।
04

শোকসভার একপর্যায়ে এই গানের সাথে মামা পিন্টু আরেং-এর সুরে সুর মেলান পাঁচ মেয়ে আল্পনা, পাপড়ি, মুক্তি, রুবি, মালা ও ছেলে জুয়েল আরেং। প্রিয়নেতাকে নিয়ে লেখা এ গানটি শোকসভার পরিবেশকে আরো ভারী, আবেগঘন ও অর্থপূর্ণ করেছে তবে বারবার দৃঢ় প্রত্যয়ে এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা দিয়ে যাচ্ছিল। কেউই চোখের পানি ধরতে রাখতে পারেননি। বাবাকে নিয়ে লেখা গানের এই লাইনগুলো যে তাদের বড় প্রিয়, বড় চেনা আর মনের কথা। কাঁদছিলেন মঞ্চের সামনে বসা সবার প্রিয় মমতা দিদিও।

বিভিন্ন ব্যক্তি, সংগঠন ও রাজনৈতিক দল তাঁর সমাধিস্থলে শ্রদ্ধাঞ্জলী অর্পণ করেন। একসময় ভক্তদের ভালোবাসা ও ফুলেল শ্রদ্ধায় ভরে যায় তাঁর সমাধিসৌধ। অনেকেই প্রিয় নেতার স্মৃতিকে স্মরণীয় করে রাখার জন্যে সমাধিস্থলে গিয়ে ছবি তুলেছেন। সবাই প্রার্থনা করছেন, সবারই একটাই চাওয়া ওপারে ভাল থাকুক তাদের প্রাণপ্রিয় নেতা। আর ওপার থেকে আশির্বাদ করুক তাঁর শতসহস্র ভক্তদের। তাঁর কর্ম ও আদর্শ নিয়ে এবং শোককে শক্তিতে পরিণত করে যেন সামনে এগিয়ে যেতে পারে।

বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে। সূর্য পশ্চিম আকাশে হেলে পড়ে। মানুষের কোলাহল ভেঙে নির্জনতা নেমে আসে। একসাথে অনেকগুলো মোমবাতি জলে ওঠে।  প্রিয়নেতার প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানিয়ে ধীরে ধীরে সবাই বাড়ির পথে পা বাড়ান। মানুষের বিনম্র শ্রদ্ধা আর ভালবাসায় জাম আর কাঠাল বৃক্ষের ছায়ায় মাটির ঘরে একা চিরনিদ্রায় শায়িত হয়ে রইলেন সবার প্রিয়, দেশ বরেণ্য ও অবিসংবাদিত নেতা এড. প্রমোদ মানকিন।

IMG_1807

দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলছে এডভোকেট প্রমোদ মানকিন কালচারাল একাডেমি নির্মাণের কাজ 

উল্লেখ্য, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্বে থাকাকালীন অবস্থায় গত বছরের ১১ মে, ভোরে লাং ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ভারতের মুম্বাই শহরের হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে মারা যান দেশবরেণ্য এই রাজনীতিবিদ।

১৯৯১, ২০০১, ২০০৮ ও ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনে ময়মনসিংহ-১ (হালুয়াঘাট-ধোবাউড়া) আসন থেকে তিনি চারবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন ।

এসএস/আরবি/১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭