শিরোনাম :
অনলাইনে কাজ শিখিয়ে ৩০০ জনের বেকারত্ব দূর করেছেন সুবীর নকরেক
||সুমন কোড়াইয়া, ডিসি নিউজ||
সুবীর নকরেক। জন্ম টাঙ্গাইলের জলছত্র ধর্মপল্লীর গাইরাগ্রামে। গ্রামেই বেড়ে উঠা। সুবীর ব্রাদার হওয়ার জন্য গিয়েছিলেন নারিন্দা সেমিনারীতে। ধর্মীয় জীবেন আহ্বান নেই বুঝতে পেরে তিনি ফিরে আসেন। পড়াশোনা শেষ করে এক বছর চাকরিও করেন।
চাকরিতে প্রজেক্ট শেষ হওয়ায় বেকার বসেছিলেন বাড়িতে। তখন তার গ্রামে কয়েকজন সরকার পরিচালিত ‘লার্নিং এন্ড আর্নিং’ অনলাইন কোর্স করেছিলেন। তিনিও এই কোর্স করার জন্য ইচ্ছা পোষণ করেন। তবে তার আগে যে দুইজন এই কোর্স করেছিলেন তারা তার আত্মীয় ছিলেন। তারা সফল হতে পারেননি।
৩০ বছর বয়সী সুবীর স্মৃতিচারণ করে বলেন, ‘তিন বছর আগে আমি যখন এই কোর্সটি করবো, তখন গ্রামের যারা এই কোর্সটি করেছিলেন তারা আমাকে নিরুৎসাহিত করেছিলেন। তারা বলেছিলেন, লাভ নাই। কিন্তু আমি দমে যাইনি। কোর্সটি ভালভাবে শেষ করেছি।’
তিনি যখন কোর্সে পরীক্ষা দিতে যান তখন সেখানে মোট কোর্স প্রার্থী ছিল দশ হাজার জন। কোর্সে সুযোগ পাবে মাত্র ৭০ জন। সুবীর ছিলেন ভাগ্যবান ও যোগ্য প্রার্থী যিনি ওই ৭০ জনের মধ্যে ছিলেন।
সুবীর জানান, তিনি অনলাইনে কোর্স চলাকালীন সময়ই ৭৫ ডলারের একটি কাজ পান। তিনি শিখছিলেন গ্রাফিক্স ডিজাইনের কাজ। দ্রুত সময়ে কাজ পাওয়ায় তার প্রশিক্ষক তাকে জিজ্ঞেস করলেন, কীভাবে তিনি কাজ পেলেন। তিনি বললেন, ‘আপনি যেভাবে শিখিয়েছেন আমি সেটা নিয়েই চেষ্টা করেছি।’ সুবীরের আরেকটি সুবিধা ছিল তিনি ইংরেজীতে ভাল।
সুবীর বলেন, ‘আমার অনলাইনে কোর্স চলাকালীন সময় কাজ পাওয়ায় আমার সাথে অন্য যারা কোর্স করছিলেন, তারা খুব অনুপ্রাণিত হলেন। কোর্স করার সময়ই আমি মার্কেট প্লেস ফিল্যান্সিং এবং ফাইভার-এ কাজ পেয়েছি। আমার সাথে যারা কোর্স করেছিলেন এদের মধ্যে কোর্স চলাকালিন সময় চার জন কাজ পেয়েছিলেন।’
দ্রুত সময়ের মধ্যে সরকারের লার্নিং এন্ড আর্নিং প্রকল্পের জন্য মেন্টর হিসেবে চাকুরীর অফার পান সুবীর, তবে তার নিকট মনে হয়েছে তিনি অনলাইনে কাজ করতেই বেশি স্বাচ্ছন্দবোধ করবেন। তাই তিনি অনলাইনেই কাজ করা শুরু করলেন।
তিনি জানান, তার স্ত্রীও অনলাইনে কাজ শিখেছেন এবং ঘরে বসে আয় করছেন। তাদের সাফল্য দেখে যারা এক সময় বিশ্বাস করতেন না যে অনলাইনে আয় করা সম্ভব, তারা এখন বিশ্বাস করছেন।
৩০ বছর বয়সী সুবীর নিজে সফল হয়েই থেমে যাননি। সমাজের জন্য দায়বদ্ধতা অনুভব করেছেন।
তিনি ডিসি নিউজকে বলেন, ‘আমাদের সমাজে আগেই ১৫-২০ জন অনলাইনে কাজ করতেন, আমি তাদের নিকট সাহায্য চেয়েছি কিন্তু তারা আমাকে সাহায্য করেননি। তবে আমার মনে হয়েছে, শুধু আমি নিজে সফল না হয়ে অন্যদের জন্য কাজ করতে পারি। তাই শুরু করলাম ‘নকরেক আইটি ইনস্টিটিউট’ যেখান থেকে অনলাইনে কাজের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।’
আরো পড়ুন: ঘরে বসে অনলাইনে আয় করছেন খ্রীষ্টিনা
সুবীরের প্রথম টার্গেট ছিল গারো ছেলে-মেয়েদের জন্য কোর্সের ব্যবস্থা করা। তবে কোর্সের কার্যকারিতা, প্রচার-প্রচারণা দেখে অন্যান্যরাও তার কোর্স করছেন। এভাবে তিনি কয়েক বছরের মধ্যে তিন শতাধিক বেকার যুবক-যুবতিকে অনলাইনে প্রশিক্ষণ প্রদান করেছেন। তার শিক্ষার্থীরা অধিকাংশই খ্রিষ্টান।
সুবীর উল্লেখ করেন, অনলাইনের চেয়ে অফলাইনে তিনি বেশি ক্লাশ দিচ্ছেন। অনলাইনে প্রশিক্ষণার্থী নিজের বাড়িতে বসে নির্ধারিত সময় ক্লাশ করতে পারেন। ‘যারাই ক্লাশ নিতে আসতেন, তারা অফ লাইনে ক্লাশ নিতে চাইতেন, আমি তাদের অন লাইনে ক্লাশ নিতে বলতাম। তারা অনলাইনে ক্লাশ নিয়ে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেন।’ বলেন সুবীর।
নকরেক আইটি থেকে ক্লাশ করে ৩শ-এর অধিক, যাদের অধিকাংশই খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের এখন স্বাবলম্বি হয়েছেন। শুধু গারোই আছে ১২০ জন, যারা কোর্স নিয়েছেন। এছাড়া ওই প্রতিষ্ঠান থেকে কোর্স নিয়েছেন চাকমা, মাহালি, মারমা, সাঁওতালসহ বাঙালি খ্রিষ্টান ও অন্যধর্মাবলম্বী মানুষ।
সুবীর বলেন, ‘আমরা যে প্রশিক্ষণ দেই সেটা এমনভাবে দেই যেন শিক্ষার্থীরা বাস্তব জীবনে কাজে লাগাতে পারেন। আমার ছাত্ররা কাজ করার সময় রাত ৩টায় ফোন দিলে, ঘুম থেকে উঠে তাদের সাহায্য করি।’
তিনি উল্লেখ করেন বলেন, ‘আমি মনে করেছিলেন ময়মনসিংহে গারোরা প্রশিক্ষণ নিতে বেশি আসবেন, কিন্তু দেখা গেল সেখানে বাঙালিরাই বেশি আসছেন। প্রশিক্ষণ নিয়ে মার্কেট প্লেসে কাজ করে উদ্যোক্তা হয়ে গেছেন অনেকে।’
সুবীর মূলত একজন ডিজাইনার। ঘরে বসে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের অফিসের জন্য গ্রাফিক্সের কাজ করেন।
তিনি বলেন, ‘আমি মূলত স্টাট আপ ব্যবসার জন্য লগো, ব্রুশিয়ার, পোষ্টার তৈরি, ওয়ার্ডপ্রেস থিম কাষ্টমাইজড এবং ডিজিটাল মার্কেটিং-এর কাজ করি।’
বর্তমানে প্রতিষ্ঠানে দুইজন কর্মী তাকে সহযোগিতা করছেন।
গ্রাফিক্সের কাজের চাহিদা
সুবীর জানান, অনলাইনে সব ধরনের কাজের চাহিদা রয়েছে। তবে গ্রাফিক্স ডিজাইন অন্যতম।
তিনি বলেন, ‘ঢাকা শহরে খেয়াল করলে দেখবেন কত রকমের বিলবোর্ড, পোষ্টার, ব্যানার। এগুলো কিন্তু গ্রাফিক্সের কাজ। ফিডারের বোতলটার পেকেটও কিন্তু গ্রাফিক্স ডিজাইন করা। আমরা সারা জীবন স্কুল, কলেজ, বিশ^বিদ্যালয়ে প্রায় ২২৫০টি বই পড়েছি। সবগুলোতে গ্রাফিক্সের কাজ করা হয়েছে। বলতে গেলে গ্রাফিক্স ডিজাইনটা সকল ক্ষেত্রেই আছে এবং ডিজাইনারের চাহিদা রয়েছে। এই পেশায় দক্ষতা থাকলে অন লাইন ছাড়াও অফ লাইনে যেমন বিভিন্ন অফিসে চাকরি পাওয়া যায়।
ডিজাইনারদের সফল হতে হলে
সুবীর বলেন, অনেক গ্রাফিক্স ডিজাইনার আছেন কিন্তু তারা তাদের কাজের ক্যাম্পেইন করেন না। তারা যদি নিজেদের কাজের নমুনা ফেসবুকে পোষ্ট করেন, তাহলে অন্য মানুষ তার কাজ সম্পর্কে জানতে পারেন। এছাড়া লিংকডিনে, টুইটারেও নিজের কাজের মার্কেটিং করা যায়। অনেকে ওয়েবসাইটের কাজ পারেন কিন্তু নিজের কাজের বিষয়ে কাউকে বলেন না। মূলকথা হলো নিজের কাজের ক্যাম্পেইন করতে হবে।
অনলাইনে সফল হতে হলে
সুবীরের মতে, ‘অনলাইনে সফল হতে হলে থাকতে হবে প্রবল আগ্রহ ও ধৈর্য। যে জিনিসটা তিনি শিখবেন, সেই বিষয়ের ওপর তার থাকতে হবে পেশন। মনে রাখতে হবে, এখানে যেহেতু আমার আগে কেউ ভাল করেছে, আমাকে তার চেয়েও ভাল করতে হবে। নিজে কাজে দক্ষ হওয়ার পাশাপাশি নিজের কাজকে প্রমোট করতে হবে।’
সুবীরের স্বপ্ন
আমি একজন প্রাক্তন সেমিনারীয়ান। হলিক্রস ব্রাদারহুডে ছিলাম। আমার ইচ্ছা, গারো ও খ্রিষ্টান যুবক-যুবতিদের কাজ শেখাবো। তাই খ্রিষ্টান অধ্যুষিত এলকাগুলোতে নকরেক আইটির শাখা খুলতে চাই, যেন সেখান থেকে কাজ শিখে অনেকে তাদের জীবনের মোড় ঘোরাতে পারেন।
সুবীরের শিক্ষার্থীদের কথা
সুবীরের নিকট কাজ শেখার ইচ্ছা পোষণ করেন দিনাজপুরের অন্তরা সরেন (২৮)। প্রথমে তার কম্পিউটারের বিষয়ে তেমন ধারণা ছিল না। তিনি গত বছর তিন মাস কোর্স করেছেন। কোর্স চলাকালিন সময় তার কম্পিউটার নষ্টও হয়ে যায়। তারপরও থেমে থাকেননি। তিনি কাজ শিখে ঘরের জন্য নতুন নতুন আসবাবপত্র কিনেছেন। শিশুকে সময় দিয়ে, ঘর সংসার সামলে মাসে কমপক্ষে ২০০ ডলার আয় করে ভালভাবে দিন অতিবাহিত করছেন। তিনি ডিসিনিউজকে বলেন, ‘আমি প্রথম প্রথম ভয়ে থাকতাম কীভাবে অনলাইনে কাজ শিখবো। কিন্তু সুবীরদা সুন্দরভাবে অনলাইনে কাজ শিখিয়েছেন, যার ফলে আমি ফাইভারে কাজ করতে পারছি। এখন আমি স্বাবলম্বি একজন নারী।’
ময়মনসিংহের ফারহান আদিব (২০) এই বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত গ্রাফিক্সের উপর কাজ শিখেছেন। তিনি এখন ফাইবার মার্কেট প্লেসে কাজ করছেন। মাসে প্রায় ২০০ ডলার আয় করছেন শুরু থেকেই। তিনি ডিসিনিউজকে বলেন, ‘সুবীরদা খুব সুন্দরভাবে আমাদের প্রশিক্ষণ দেন। আমি তার প্রশিক্ষণ পেয়ে স্বাবলম্বি হতে পেরে তার প্রতি কৃতজ্ঞ।’
শেষ কথা
সুবীর বলেন, আমার খুব ভালোলাগে যখন কোনো প্রশিক্ষণার্থী বলে, দাদা আমি এই মাসে এক হাজারের বেশি ডলার আয় করেছি, আমি এই আসবাবপত্র কিনেছি এবং সেটার ছবি তুলে আমাকে দেখান। তারা আমার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। কোর্স প্রদান করে নিজেকে স্বার্থক মনে হয়।’
সুবীর আরো বলেন, আমাদের খ্রিষ্টান কমিউনিটির অনেকে আইটি সেক্টরের বিষয়ে ভালভাবে জানেন না। আমি চাই খ্রিষ্টান যুবক-যুবতিদের প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের বেকারত্বের হাত থেকে রক্ষা করতে।
কোর্সের মেয়াদ ও কোর্স ফি:
গ্রাফিক্স ডিজাইন অথবা ফ্রিল্যান্সিং মেয়াদ: দুই মাস, যার কোর্স ফি: ১২,০০০ টাকা, ওয়েব ডিজাইন কোর্স ছয় মাস যার কোর্স ফি ১৫,০০০ টাকা
ক্লাশের সময়: রাত: ৮-১০ অথবা ১০-১২
যোগাযোগ: ০১৮৭৫৮৬৪৬৯৯