ঢাকা ,
বার : রবিবার
তারিখ : ১৯ মে ২০২৪
বাংলা : ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১
Dcnewsbd Facebook
Dcnewsbd Twitter

শিরোনাম :

প্রথম পাতা ঢাকা ক্রেডিট সফল রেন্ট-এ কার ব্যবসায়ী আলফ্রেডের গল্প

সফল রেন্ট-এ কার ব্যবসায়ী আলফ্রেডের গল্প

0
2733

|| হিমেল রোজারিও ||

মেহেরপুর জেলার মুজিবনগর থানার বল্লভপুর গ্রামে জন্ম আলফ্রেড স্বাধীন মন্ডলের। তবে গ্রাম ও শহরের বেশির ভাগ মানুষ স্বাধীন নামেই ডাকে। গ্রামের স্কুলেই প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন। কুষ্টিয়া জেলা স্কুল থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষায় অংশ গ্রহণ করে। কিন্তু প্রথমবার তিন নম্বরের জন্য অকৃতকার্য হন। হাল ছাড়েননি। পরের বার ঠিকই কৃতকার্য হয়েছেন। এর পরে আর পড়াশোনা হয়ে উঠেনি স্বাধীনের। পাশের বাড়ির এক মুসলমান চাচা তাকে কুষ্টিয়া রূপালী ব্যাংকে একটি পিওন পোস্টে চাকরি গ্রহণে সাহায্যে করেন। তিনি বেশ কিছু দিন পিওন পোস্টে চাকরি করেন।
চাকরি করার পাশাপশি স্বাধীন ছুটির দিনে ড্রাইভিং প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতেন। ড্রাইভিং প্রশিক্ষণ শেষ করার পর পেশাদার লাইসেন্স রেব করেন। পরে ঢাকার আসেন ১৯৯৬ সালে। প্রথমে কিছুদিন বড় ভাইয়ের সাথে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলে ছিলেন। এর পরে একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে গাড়ি চালক হিসেবে চাকরি পান। এভাবে পর পর তিনটি প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করেন। পরে ১৯৯৮ সালে মিরপুরে অবস্থিত হংকং’র রাড্ডা কোম্পানিতে চাকরি পেলেন।

আরো পড়ুন: ঘরে বসে অনলাইনে আয় করছেন খ্রীষ্টিনা

তৎকালীন সময়ে ‘রাড্ডা কোম্পানি’তে ১৪টি গাড়ির জন্য ১৪টি ড্রাইভার ছিল। ড্রাইভারদের সাথে ভালো সম্পর্ক থাকার কারণে জানতে পারেন অনেক ড্রাইভাররা নিজেরা গাড়ি ক্রয় করে অন্য কোম্পানিতে ভাড়া দেন। তখন থেকে স্বাধীনের মনে গাড়ি ক্রয় করার ইচ্ছা জাগে। স্বাধীনের প্রতিবেশী এক ড্রাইভার চাচার সাথে একটি পুরাতন গাড়ি ক্রয় করার বিষয়ে আলোচনা করেন। যেই আলোচনা সেই কাজ। চাচা-ভাতিজা ২০০৩ সালে ১৫ সিটের একটি পুরাতন গাড়ি ২ লক্ষ ৪০ হাজার টাকায় ক্রয় করেন। মানুষের সাথে ভালো পরিচিতি ও ভালো ব্যবহারের কারণে তাদের দুই জনের গাড়ি ভাড়া প্রদানের মাধ্যমে আয় বাড়তে থাকে। এর পর আরো দুটি পুরাতন গাড়ি ক্রয় করে ভাড়া দেন। চাকরির পাশাপাশি তার প্রতিদিন আয় বাড়তে থাকে। সেই সাথে বাড়তে থাকে মানুষের পরিচিতি, বৃদ্ধি পায় নেটওয়ার্ক।
১৯৯৮ সালে ঢাকা ক্রেডিটে তার শুধু সঞ্চয়ী হিসাব ছিল। পরবর্তীতে ঢাকা ক্রেডিটের সদস্যপদ গ্রহণ করেন। স্বাধীন যখন বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে জানতে পারলেন ঢাকা ক্রেডিট গাড়ি ঋণ প্রদান করছে, তখন তার শেয়ার বৃদ্ধি করে ২০১০ সালে একটি ঋণ হিসেবে নতুন গাড়ি নিলেন সমিতি থেকে। আগের সবগুলো গাড়ি পুরাতন ছিল। ঢাকা ক্রেডিট থেকে ঋণের মাধ্যমে নেওয়া গাড়িটি ছিল তার নিজের ক্রয়কৃত নতুন গাড়ি। ২০১৩ সালে ঢাকা ক্রেডিট থেকে স্বাধীন মন্ডল আরেকটি ডাউন পেমেন্টে নতুন গাড়ি নেন। এরপর ২০১৫ সালে আরেকটি গাড়ি নিয়েছেন ঢাকা ক্রেডিট থেকে। ঢাকা ক্রেডিটে নিয়মিত ঋণ ফেরত দেওয়ার সুবাদে ২০১৬ সালে চতুর্থ বারের মতো নতুন গাড়ি নিলেন।
তখন তার গাড়ির সংখ্যা দাঁড়ায় মোট আটটিতে। আটটি গাড়ির মধ্যে ছয়টি গাড়ি ছিল স্বাধীনের নিজস্ব অর্থে ক্রয় করা। বাকি দুটি গাড়ির অংশিদার হিসেবে ক্রয় করেন। একসময় সেই দুটি গাড়ির টাকা পরিশোধ করে নিজের নামে করে নেন। ঢাকা ক্রেডিট থেকে চারটি গাড়ি ঋণ নিয়েছিলেন তা কিছুদিন পূর্বে সম্পূর্ণ পরিশোধ করেছেন।
২০০৫ সালে স্বাধীন মন্ডল রেন্ট-এ কার ব্যবসা করার জন্য ট্রেড লাইসেন্স গ্রহণ করেন। তার রেন্ট-এ কারের নাম ‘সৃষ্টি রেন্ট-এ কার’। সৃষ্টি রেন্ট-এ কারে পাঁচজন ড্রাইভার কাজ করছেন। চারটি গাড়ি বেশি পুরাতন হওয়ার কারণে এবং নিজের চাকরির কাজের চাপ বেশি থাকার কারণে স্বাধীন চারটি গাড়ি বিক্রয় করে দিয়েছেন। আবার কিছু দিন পরে নতুন মডেলের আপডেট গাড়ি ক্রয় করার চিন্তা করছেন।
তিনি জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে গাড়ি ভাড়া দেন। বিভিন্ন বিদেশী কোম্পানিতে তিনি মাস হিসেবে গাড়ি ভাড়া দিয়ে থাকেন। বিশেষ করে কোরিয়ান কোম্পানিতে স্বাধীনের গাড়ি ভাড়া দেন। কোম্পানিতে গাড়ি ভাড়া দিলে সময়মতো ভাড়া পাওয়া যায়, কোন সমস্যা হয় না।
২০১৭ সালের নভেম্বর মাসে বাংলাদেশে যখন পোপ ফ্রান্সিস আসেন, তখন তিনি তিনটি গাড়ি ভাড়া দিয়েছিলেন। তার মধ্যে একটি গাড়ির জন্য কোনো ভাড়া রাখেননি। স্বাধীন বলেন, ‘আমি অনেক ভাগ্যবান পোপের প্রতিনিধিরা আমার গাড়িতে উঠেছেন। এটা আমার জন্য একটি বড় আশীর্বাদ।’
প্রত্যেকের জীবনে একবার না একবার সুবর্ণ সুযোগ আসে। ঠিক তেমনি স্বাধীনের জীবনে এসেছিল ইতালীতে যাবার। মিরপুর-১০’এ পিমে সিস্টার বাড়িতে বিকালে অফিস থেকে ফেরার পর পার্ট-টাইম কাজ করতেন। তখন একজন সিস্টার তাকে ইতালীতে নিয়ে যাবার প্রস্তাব দিয়েছিলেন,একজন ড্রাইভার হিসেবে। তখন স্বাধীন সিস্টারকে তার পরিবার ছেড়ে বিদেশে থাকতে পারবেন না বলে জানিয়েছিলেন। কারণ চার মাস আগে তার একটি ছেলে হয়েছে। তখন সিস্টার স্বাধীনকে বলেছিলেন, চার বছর পরে স্বপরিবারে ইতালীতে চলে যেতে পারবে। কিন্তু স্বাধীন নিজের স্ত্রী-পুত্র, পিতা-মাতাকে ছেড়ে যেতে রাজি হননি।
প্রতিটি ব্যবসায়ে ঝুঁকি বিদ্যমান। গাড়ি ব্যবসায় আরো বেশি ঝুঁকি রয়েছে। স্বাধীনের পাঁচটি গাড়ির মালিক হয়েছেন জেনে মিরপুরের কিছু নেতার লক্ষাধিক টাকা চাঁদা দাবি করেন। এলাকায় ভাল পরিচিতি এবং মানুষের সাথে ভাল সস্পর্ক থাকার কারণে নেতৃস্থানীয় ব্যক্তির মাধ্যমে বিষয়টি সমাধান করেন। এর পরে আর কেউ কখনো স্বাধীনের কাছ থেকে চাঁদা দাবি করেনি।
এ ছাড়া গাড়ি দুর্ঘটনা বাংলাদেশে একটি নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিদিন খররের কাগজে চোখ মেললেই সড়ক দুর্ঘটনার খবর পাওয়া যায়। কিন্তু স্বাধীনের ক্ষেত্রে একেবারে ব্যতিক্রম। তার রেন্ট-এ কার চালিত গাড়ি ঈশ^রের আশীর্বাদে কখনো বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটেনি, এমন কি কোনো ড্রাইভারের অঙ্গহানির ঘটনাও ঘটেনি।
স্বাধীন বলেন, রেন্ট-এ কারের গাড়ি চালকদের বেতন সাত হাজার টাকা, কিন্তু আমি প্রদান করি ১২ হাজার টাকা। দূরে কোথাও কোনো ট্রিপে গেলে ফিরে আসার পরে তাকে কিছু বোনাস প্রদান করি। তাছাড়া প্রতিদিন দুপুরের খাবারের জন্য একশত টাকা বরাদ্দ রয়েছে। ড্রাইভারদের চাহিদা পূরণ না করলে তাদের তেল চুরির একটি প্রবনতা থাকে। অথবা ইচ্ছা করে অনেক সময় গাড়ির বড় ধরনের ক্ষতি করে থাকে। যথাসাধ্য চেষ্টা করে থাকি ড্রাইভারদের চাহিদা পূরণ করার জন্য। এই জন্য আমার গাড়িগুলোর তেমন বড় ধরনের কোনো ক্ষতি করে নি কোন ড্রাইভার। যদি কোনো ড্রাইভারকে বরখাস্ত করি তখন তাকে এক মাসের বেতন অগ্রিম প্রদান করে বরখাস্ত করে থাকি, যেন কোনো দূরে গিয়ে কোনো প্রকার খারাপ মন্তব্য করতে না পারে।
সৃষ্টি রেন্ট-এ কারে মুসলিম একজন ড্রাইভার (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) অনেক দিন যাবৎ কাজ করেন। এই ড্রাইভার একটি গাড়ি ক্রয়ে ইচ্ছা পোষণ করেন এবং স্বাধীনের কাছে তার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। কিন্তু গাড়ির শো-রুমের মালিক সুমলিম এই ড্রাইভারকে গাড়ি প্রদানের কোনো ভরসা পাচ্ছিলেন না। তখন স্বাধীন নিজে গিয়ে শো-রুমের মালিককে বলেন: ‘যদি এই ড্রাইভার গাড়ির টাকা পরিশোধ না করে তাহলে আমি নিজে পরিশোধ করবো’ বলে চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করেন। গাড়ি ক্রয়ের পরে মুসলিম লোকটি সৃষ্টি রেন্ট-এ কারের কাছেই গাড়িটি ভাড়া দেন। একইভাবে ঢাকা ক্রেডিট থেকে দুইজন সদস্যকে গাড়ি ঋণ নিতে সহায়তা করেছেন এবং জামিনদার হয়েছেন স্বাধীন।

আরো পড়ুন:আইটি পেশাজীবীদের নিয়ে ঢাকা ক্রেডিটের মতবিনিময়

প্রায় ২২ বছর যাবৎ স্বাধীন ঢাকা বসবাস করছেন। শুধু গাড়ি চালানোর অভিজ্ঞতা নিয়ে ঢাকায় প্রবেশ করলেও ধীরে ধীরে তিনি হয়েছেন একপুত্র ও কণ্যা সন্তানের বাবা। ছেলেটি এবার নটর ডেম কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় অংশ নিয়েছেন। নটর ডেম কলেজ থেকে ছেলে পাস করলে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করানোর স্বপ্ন দেখছেন স্বামী-স্ত্রী দুজনেই। মেয়েটি দশম শ্রেণিতে পড়াশোনা করছে। অপর দিকে স্বাধীনের স্ত্রী মিরপুর শিশু হাসপাতালে নার্সের চাকরি করেছেন। দুটি ছেলে-মেয়েকে পড়াশোনা করানোর পরেও নিজ গ্রাম বল্লভপুরে কিছু ধানী জমিও ক্রয় করেছেন। সেই সাথে ঢাকায় একটি ফ্ল্যাটের জন্য প্রতিমাসে কিস্তি প্রদান করছেন। ২০২০ সালে ফ্ল্যাটটি স্বাধীনের কাছে হস্তান্তর করবেন মালিক পক্ষ।
স্বাধীন কৃতজ্ঞতার সহিত সমবার্তাকে বলেন, ‘ঢাকা ক্রেডিট গাড়ি ঋণ এবং সাধারণ ঋণ দিয়ে আমাকে সাহায্যে করেছে এবং ঈশ^র করেছেন আর্শীবাদ। নতুবা কখনো সম্ভব হতো না দুটি সন্তাননের ভরণ-পোষণ ও তাদের লেখাপড়া করানো। স্বাধীনের এই সাফল্যের পেছনে রয়েছে অদম্য ইচ্ছা, সাহস, পরিশ্রম ও সততা। এই কারণেই আজ তিনি সফল ও সার্থক।

হিমেল রোজারিও‘র আরো এই ধরনের লেখা পড়ুন:

টিনের ঘর থেকে অট্টালিকা