ঢাকা ,
বার : শনিবার
তারিখ : ১৮ মে ২০২৪
বাংলা : ৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১
Dcnewsbd Facebook
Dcnewsbd Twitter

শিরোনাম :

প্রথম পাতা সম্পাদকীয় উপ-সম্পাদকীয় “সমস্ত সৃষ্টি আজও পর্যন্ত যেন প্রসব-বেদনায় গুমরে মরছে।”

“সমস্ত সৃষ্টি আজও পর্যন্ত যেন প্রসব-বেদনায় গুমরে মরছে।”

সাধারণকালের পঞ্চদশ রোববারের উপদেশ

0
836

|| কার্ডিনাল প্যাট্রিক ডি’রোজারিও, সিএসসি ||

আজকের দ্বিতীয় পাঠে রোমীয়দের নিকট সাধু পল বলছেন: “বিশ্বসৃষ্টি ব্যাকুল প্রত্যাশা নিয়ে প্রতীক্ষায় রয়েছে, ঈশ্বর কবে তাঁর সন্তানদের সেই মহিমার অলৌকিক প্রকাশ ঘটাবেন। বিশ্বসৃষ্টিকে ব্যর্থতার বন্ধনে বেঁধে রাখা হয়েছে  তবুও বিশ্বসৃষ্টির এই আশা রয়েছে যে, সেও একদিন অবক্ষয়ের দাসত্ব থেকে মুক্ত হয়ে উঠবে সমস্ত সৃষ্টি আজও পর্যন্ত যেন প্রসব-বেদনায় গুমরে মরছে।”  (দ্র: রোমীয় ৮:১৮-২৩)

বর্তমান করোনা-ভাইরাসের দুর্যোগকালে সাধু পলের কথাগুলো অনেক অর্থপূর্ণ। বর্তমান সংকট বুঝতে আমাদের মনকে আলোকিত করছে। অনেক বিজ্ঞানী ও পরিবেশবাদী, অর্থনীতিবিদ, এমনকি রাজনীতিবিদরা বর্তমান করোনা ভাইরাস মহমারীর কারণ হিসেবে দেখছে সৃষ্টি ও প্রকৃতিকে দাসত্বে আনার মানুষের দৌরাত্ম। সাধু পল আরও বলছেন: “বিশ্বসৃষ্টিকে ব্যর্থতার বন্ধনে বেঁধে রাখা হয়েছে”। 

বর্তমান যান্ত্রিক উন্নয়নের অনেক আশীর্বাদের সাথে সাথে অনেক অভিশাপও আমাদের জন্য এসেছে: ঘটছে প্রকৃতি ও পরিবেশের বিপর্যয়, জলবায়ুর পরিবর্তন, জীববৈচিত্রের অবলুপ্তি, জল-বায়ূ-শব্দ-মাটির অত্যাধিক দূষণ, পানি ও খাদ্যদ্রব্যের নিরাপদহীনতা, জিনিসপত্র ফেলে-দেওয়ার কৃষ্টি, বর্জ দ্বারা সৃষ্ট অনেক আবর্জনা; জিনিসপত্রের অপব্যবহার ও অপচয়; বিশ্বব্যাপী রয়েছে অসমতা: ধনী ও গরিব দেশ ও শ্রেণির মধ্যে বিরাট ব্যবধান, শহর ও গ্রামের মধ্যে অসমতা, জাতিগোষ্ঠির মধ্যে বৈষম্য, অসম বন্টন, অসম স্বাস্থ্য-ব্যবস্থা; তথ্যের বিভ্রান্তি, মাত্রারিক্ত ভোগবিলাস আবার চরম দারিদ্র; প্রকৃতিজাত, সুষম ও পুষ্টিকর খাদ্যের অভাব; রোগ-পীড়া, মহামারির প্রাদুর্ভাব; পৃথিবীর উদ্ভিদ ও প্রাণী জাতির বিলোপন; অভিবাসন, বাস্তুুহারা ও স্মরণার্থীদের সংখ্যাধিক্য, ইত্যাদি।

এই সবকিছুকেই সাধু পল বলছেন “পৃথিবীর অবক্ষয়ের দাসত্ব”।  সাধু পল এও বলছেন: “তবুও বিশ্বসৃষ্টির এই আশা রয়েছে যে, সেও একদিন অবক্ষয়ের দাসত্ব থেকে মুক্ত হয়ে উঠবে ÑÑ সমস্ত সৃষ্টি আজও পর্যন্ত যেন প্রসব-বেদনায় গুমরে মরছে।” 

পিয়জনেরা, পোপ ফ্রান্সিস বলছেন যে, আমাদের এই পৃথিবী “সবার বসতবাটি”। এই বসতবাটি বিলাপ করছে, কান্না ও আর্তনাদ করছে। “সমস্ত সৃষ্টি যেন প্রসব-বেদনায় নিদারুণ কাতরাচ্ছে।” এর জন্য দায়ী কে? মানুষ। মানুষই প্রথিবীটাকে তার দাসত্বে বেঁধে রেখেছে। অতএব মানুষকে মন পরিবর্তন করতে হবে। তাকে সৃষ্টি ও প্রকৃতিকে ভালবাসতে হবে ও যত্ন নিতে হবে। আর মানুষ কর্তৃক সৃষ্ট দাসত্ব থেকে পৃথিবীটাকে মুক্তি দিতে হবে।  সুবিধা-বঞ্চিত ও দরিদ্রদের সাথে একাত্ম হয়ে জীবনযাপন করতে হবে। সৃষ্টিকর্তার প্রতি অনুগত থেকে, পৃথিবীটাকে দাসত্বে না রেখে, মানুষ বিশ্বস্ত কর্মচারী হয়ে সৃষ্টির যত্ন নেবে। 

করোনাভাইরাসের প্রকোপে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সবাই জর্জরিত ও আক্রান্ত। এর জন্য মানুষই দায়ী। মহামারির আঘাত সবার ওপরে, বর্তমানে ও ভবিষ্যতে, আরও কতকাল ধরে।  কেউ-ই বাদ পড়ছে না। মহামারির ফলে মানুষ যখন বিপর্যস্ত, তখন দেখা যাচ্ছে প্রকৃতি, উদ্ভিদ, প্রাণী জগত ও পরিবেশের মধ্যে একটি স্বস্তির অনুভূতি, তারা নতুন জীবন পেয়েছে। প্রকৃতি সবুজ ও সজীব হয়ে উঠেছে, ফুলে-ফলে সৃষ্টির সৌন্দর্য বেড়ে গেছে। মানুষ অল্পেতে সন্তুষ্ট, খরচ-পাতি ও সামাজিক উৎসব ও আনুষ্ঠানাদির বাহুল্য নেই, যাতায়ত ব্যবস্থায় একটা নিয়ম-শৃঙ্খলা ফিরে এসেছে, অপচয় কমছে, মানুষ আরও পরিষ্কার ও পরিচ্ছন্ন জীবনযাপন করছে। গৃহবন্ধী অবস্থায় মানুষ তার মানবিক জীবনের মূলে ও তার গভীরে প্রবেশ করার সুযোগ পাচ্ছে; করোনা দুর্যোগের সময় ঈশ্বরের করুণার ওপর, তাঁর দয়া ও ভালবাসার ওপর মানুষ ভরসা করছে।  খ্রিষ্টানদের ঘরে ঘরে যিশুকে আবার স্থান দেওয়া হচ্ছে, প্রতিটি ঘর হয়ে উঠেছে: ঐশ-উপাসনালয়, খ্রিষ্টসাধনালয় ও মানব-সেবালয়।

পোপ ফ্রান্সিস প্রশ্ন করছেন: আমাদের ভবিষ্যত সন্তানদের হাতে কী ধরনে পৃথিবী রেখে যেতে চাই? বর্তমান করোনা দুর্যোগই হচ্ছে ধরণীর বিলাপ এবং দরিদ্র, অসুস্থ ও করোনায় আক্রান্ত জনগণের কান্না ও মৃত্যুর মিছিল।

এ অবস্থায় আমাদের করণীয় কী? প্রথমতঃ সৃষ্টি ও দরিদ্র মানুষের প্রতি আমাদের দায়িত্ব সম্বন্ধে সচেতন হতে হবে: ধর্মবিশ্বাসের আলোকে প্রকৃতি, পরিবেশ ও সৃষ্টিকে দেখতে হবে; স্মরণে রাখতে হবে যে, যান্ত্রিক উন্নয়নই মানুষের প্রকৃত উন্নয়ন নয়; উন্নয়ন হতে হবে মানবিক, তথা খ্রিষ্টীয়।

আজকের ২য় শাস্ত্রপাঠে, সাধু পলের কথা অনুসারে, আমি কী সংকল্প বা অঙ্গীকার নিতে পারি? আমি অঙ্গীকার করতে পারি যে, আমি সৃষ্টির জন্য এবং সৃষ্টির সাথে এক হয়ে প্রার্থনা করব; আরও সহজ-সরল জীবন যাপন করব; আমাদের সর্বসাধারণের বসতবাটি এই পৃথিবীর প্রকৃতি ও পরিবেশের পক্ষে কথা বলব; খাদ্য ও পানি অপচয় করবো না; আমার যা প্রয়োজন শুধু তাই ক্রয় করবো, সকল বর্জ দিয়ে আবর্জনা সৃষ্টি করব না; আমাদের সবার বসতবাড়ী, আমাদের পৃথিবীটাকে সুরক্ষা করার জন্য অন্যের সাথে একযোগে কাজ করব ও  অপরকে প্রেরণা দেব। 

আমরা প্রত্যেকেই প্রাত্যহিক ও ব্যাহারিক জীবনে কয়েকটি জরুরী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারি, যেমন:

(১) পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকা ÑÑ নিজের দেহ থেকে শুরু করে পোশাক-আশাক, ঘরবাড়ী, রাস্তা-ঘাট-মাঠ, কর্মস্থল, সমাবেশস্থল, প্রভৃতির পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রাখব;

(২) জিনিসপত্র ও দ্রব্যসামগ্রীর অপব্যবহার, অপচয়, অতিরিক্ত খরচপাতি পরিহার করব।

(৩) সকল প্রকার দূষণ Ñ শব্দ-বায়ূ-জল-মাটি দূষণ থেকে বিরত থাকব;

(৪) প্রকৃতিজাত, বিশুদ্ধ ও সুষম খাদ্য আহার ও পানীয় পান করার অভ্যেস গড়ে তুলবো। 

সকল করণীয়, অঙ্গীকার ও পদক্ষেপ যদি আমরা গ্রহণ করি, তা হলে মঙ্গলসমাচারে বর্ণিত বীজবপকের মতো এবং আমরা নিজেরা ভালো মাটি হয়ে ঐশরাজ্যের বীজ গ্রহণ করতে পারব এবং একদিন তাতে শতগুণ ফসল ধারণ করাতে পারব।  সৃষ্টি ও পরিবেশ সম্বন্ধে ঈশ্বরের বাণী ও খ্রিষ্টমণ্ডলীর শিক্ষা, আজকের প্রথম পাঠে ইসাইয়া প্রবক্তার বাণী অনুসারে, আকাশ থেকে নেমে-আসা বৃষ্টি কোনোভাবে নিস্ফল হয়ে ফিরে যাবে না। বৃষ্টিতুল্য ঐশবাণী পৃথিবীকে জলসিক্ত করবে, পৃথিবীর বুকে নতুন ফসলের জন্ম ও বৃদ্ধি ঘটাবে।  ঐশরাজ্যের বাণী  নতুন ফসল ফলিয়ে ও তার কাজ সমাধা করে, আবার আকাশে ফিরে যাবে। 

“বিশ্বসৃষ্টি ব্যাকুল প্রত্যাশা নিয়ে প্রতীক্ষায় রয়েছে, ঈশ্বর কবে তাঁর সন্তানদের সেই মহিমার অলৌকিক প্রকাশ ঘটাবেন।” আমরা বিশ্বাস, ভালবাস ও আশা নিয়ে সেই মহিমার প্রতীক্ষায় থাকি।  ঈশ্বর সকলকে আশীর্বাদ করুন।  আমেন। 

আমাদের ধরিত্রীর জন্য প্রার্থনা

হে সর্বশক্তিমান ঈশ্বর,

তোমার সৃষ্টি অপরূপ, তোমার সৃষ্টির জন্য আমরা তোমার প্রশংসা করি।

আমাদের ওপর তোমার ভালবাসার শক্তি বর্ষণ করো

আমরা যেন সমস্তকিছুর প্রাণ ও সৌন্দর্য সংরক্ষণ করতে পারি।

তোমার শান্তিবারিতে সিক্ত কর

যাতে আমরা কারো ক্ষতি না করে

পরস্পরের সাথে ভাইবোন হিসেবে জীবনযাপন করতে পারি। 

হে দরিদ্র জনগণের প্রভু ঈশ্বর

আমাদের জীবনযাত্রা নিরাময় কর

আমরা যেন জগতটাকে ভক্ষণ না করে বরং রক্ষণাবেক্ষণ করতে পারি।

আমরা যেন একে আবর্জনা ও ধ্বংসস্তুপে পরিণত না করি,

বরং আমরা যেন চারিদিকে সৌন্দর্য বিস্তার করতে পারি। 

যাদের হাতে ক্ষমতা ও অর্থসম্পদ আছে তাদের হৃদয়মন আলোকিত কর,

তারা যেন উদসীনতার পাপ থেকে মুক্ত থাকতে পারে।

তারা যেন গণমঙ্গলকে ভালবাসতে পারে,

দুর্বল-অসহায়দের উন্নয়নকল্পে সহায়তা করতে পারে,

এবং আমাদের এই আবাসভূমি পৃথিবীটার যত্ন নিতে পারে।

দীনদরিদ্র মানুষ ও বিশ্বজগৎ আর্তনাদ করছে, তা তুমি শ্রবণ কর।

তোমার রাজ্য: ন্যায্যতা, শান্তি, ভালবাসা ও সৌন্দর্যের রাজ্যে

আগমনের জন্য আমাদেরকে তোমার বিশ্বস্ত কর্মী করে তোল।

তোমার প্রশংসা হোক।  আমেন।

 “লাউডাটো সি” বিশ্বজনীন পত্র থেকে পোপ ফ্রান্সিসের প্রার্থনার অংশবিশেষ, ২০১৫।  

১২ জুলাই, ২০২০